বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ নভেম্বর ১৯৭১
পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রেরিত
শয়তানের ছল-চাতুরী
—বিষ্ণু দাস
প্রবাদ আছে “শয়তানের ছলের অভাব হয় না।” এটার সত্যাসত্য এর আগে অনেকেই প্রমাণ করেছে, কিন্তু এবার সবাইকে টেক্কা দিয়ে সহচর টিক্কা সহযোগে রণোন্মত্ত শয়তান ইয়াহিয়া জীবন্ত সাক্ষ্য থাকবে মরণের পরেও। শয়তান বলাটাও যথেষ্ট যুক্তিপুর্ণ কিনা সে সম্পর্কে আমিও সন্ধিহান, ওকে একমাত্র বলা যেতে পারে নরদেহধারী নরখাদক।
আজ প্রায় সাতমাসেরও বেশী বাংলাদেশে চলছে তান্ডবলীলা। সেই তান্ডবলীলার হোতা নরখাদক ইয়াহিয়া চক্রকে বারে বারে আঘাত হানছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। শুধুই আঘাত হেনে ক্ষান্ত হয়নি, দিকে দিকে খানসেনাদের পর্যুদস্ত আর খতম করে শত্রু কবলিত জায়গাগুলোকে মুক্ত করছে। ওদের ভবলীলা সাঙ্গ করে মা, বোন আর স্বজন হারানোর প্রতিশোধ নিচ্ছে। সাবাস মুক্তিফৌজ, সাবাস বাংলা দেশের নওজোয়ান। এখনইতো সময় কড়ায় গন্ডায় বুঝে নিতে এবং বুঝিয়ে দিতে হবে বাংলাদেশ আমাদেরই, সাড়ে সাত কোটি মানুষের, এখানে শয়তানের ঠাঁই নেই, এটা তোমাদের জন্য নয়। এখন মুক্তিবাহিনী শৈশব কাটিয়ে এসছে, শুধু হাতে লড়ছে না তাই জঙ্গীশাহী ভীতসন্ত্রস্ত। কিন্তু রক্তের স্বাদ যে পেয়েছে একবার সে আরও চেষ্টা করছে ছলে বলে কলে কৌশলে ক্ষমতা রাখবার।
কিছুদিন আগে বাংলাদেশের স্বাভাবিকতা প্রমাণ করবার জন্য খানচক্রে নাকি পূজার আয়োজন করেছিল। সে পূজার পুরোহিত করেছিল এক লম্পট সেনানীকে। হয়ত খোঁজ করলে দেখা যাবে সেই সেনানী কতজনের যে প্রাণ নিয়েছে তার ইয়ত্তা নাই, তবু ওস্তাদকে সম্মানের তুঙ্গে বসানোর দায়িত্ব এদেরই, তাই বসেছিল পূজোয়। কিন্তু সত্যের ঢাক আপনি বাজে। নরঘাতক পুরোহিত যখন পূজা করছিল আর এক নরঘাতক এসে জিজ্ঞাসা করে কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা, উত্তরে তখন ঐ পুরোহিত ভুলে গেছে তার সামাজিক রূপের কথা সে জার পূছলনা করে মন্ত্রোচ্চারণের ভঙ্গিতে ঠোঁট নাড়ছিল, বন্ধ হয়ে গেল ঠোঁট নাড়া, উঠে সঙ্গে সঙ্গে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানালো তার প্রশ্নকর্তাকে। অদ্ভুত ব্যাপার, দুজনই হতচকিত হয়ে কিছুক্ষণ কাটালো। ইয়াহিয়ার এটাও অন্যতম বড় চাতুরী।
যাই হোক আমি আগেই বলেছি সত্যের ঢাক আপনি বাজে, তারও এক প্রমাণ পেলাম আমি নিজেই। একদিন হঠাৎ কৌতুহলবশে রেডিও পাকিস্তান ইয়াহিয়াশাহীর মিথ্যা অপপ্রচার। হঠাৎ কাণে বাজলো ‘মুক্তিবাহিনীর গতি এখন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।” সাময়িক আশ্চর্য্য হইনি এমন কথা বলবনা, উল্লাসিত হয়েছিলাম যথেষ্ট পরিমাণে আর গর্বে বুকটা ভরে গিয়েছিল এই শুণে যে খাস ইয়াহিয়ার বেতনভুকরাও এই দুর্বার গতি মুক্তিফৌজকে আর অস্বীকার করতে পারছেনা। ততোধিক উদ্বেলিত হলাম সেই বীর রসে ভরা “মুক্তিবাহিনী” কথাটা শুনে। হ্যাঁ ঠিকইতো এই মুক্তিবাহিনী আজ পৃথিবীর দিকে দিকে নিজেদের অমূল্য সুন্দর জীবন বিসর্জন দিয়ে পার্থিব সুখ-স্বাচ্ছন্দকে জলাঞ্জলি দিয়ে সংগ্রাম করছে নিজের দেশমাতৃকাকে উৎপীড়ন আর লাঞ্ছনার হাত থেকে মুক্ত করতে, সদানন্দে থাকবার পথ নিষ্কন্টক করে যাচ্ছে তাদেরেই কচি কচি ভাইবোনদের। এদের কাজের মধ্যে কিন্তু এতটুকু খাদ নেই, নেই ছল চাতুরী। আছে শুধু উদ্দীপনা, প্রেরণারূপী পাথেয়, আর লৌহদৃঢ় শপথ। তাইতো এরা অতিক্রম করতে পারছে এই দুর্গম বন্ধুর পথ। এরা মরেও অমর, এদের রক্তের প্রতিটি বিন্দু বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষের রক্তের অণুপরমাণুতে মিশেছে, তাদের রক্তকে লাল থেকে আরও লাল করে দিচ্ছে, প্রতিশোধের লোহিত কণিকাকে অনেক সজীব করে মনে করিয়ে দিচ্ছে “তোমরাও ছেড়ো না, ক্ষমা করো না, সমুচিত জবাব দিও” যারা আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়েছে, চোখের মণিকোঠা থেকে তন্দ্রা পর্যন্ত হরণ করেছে, এরা কোনদিন ছিল না, কোনদিনই থাকতো না, এরা পরগাছা।
অদ্ভুত ব্যাপার, ছলের শেষ নেই রাজাকরদের বুঝিবা। প্রতিশ্রুতি দিয়েই ছেড়ে ছিল; কিন্তু কোথায় রাজা আর কোথাই বা মন্ত্রী! সেই রাজাকররা প্রায় নিঃশেষিত নয়বা ভুল ভেঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে বাংলাদেশের সুন্দর আর উজ্জ্বল ভবিষ্যত স্রষ্টাদের কাছে। কিন্তু অসুর ইয়াহিয়া চেষ্টার ক্রটি করছে না নতুন নতুন কৌশল ফাঁদতে। তাই বোধ হয় বাংলাদেশের যুবকদের পরোয়ানা দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছে এবং গোপনে পাঠাচ্ছে ষড়যন্ত্র আর ভ্রাতৃঘাতী কলহ বাধাবার অপপ্রয়াস নিয়ে। কিন্তু ভুলে যাচ্ছ ইয়াহিয়া, তোমার রক্ত কলুষিত, কিন্তু এদের রক্ত এখনও নিষ্কলুষ। এরা তোমার পরোয়ানা আর বেয়োনেটের ভয়ে ভুল করলেও, সেটা একান্তই সাময়িক। পরক্ষণেই তোমার নিয়োজিত গোপন ষড়যন্ত্রকারীরা অনুতপ্ত হচ্ছে নিজেরই আত্মঘাতী কাজের কথা ভেবে। তার অনেক প্রমাণ তো আমরা পাচ্ছি।
এটা জেনো ইয়াহিয়া ভয় আর ধোঁকা দিয়ে মানুষকে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যায় না, যেমন আগুনকে চাপা দিয়ে নেভানো যায় না। নেভাতে হলে চাই শান্তি ও সংহতির মধুর সিঞ্চণ। সেই আগুন নিয়ে খেলা করছ তুমি। জান না এই আগুনই চিতাশয্যা রচনা করছে চিরতরে তোমাকে তুলে নেওয়ার জন্য, প্রস্তুত হও।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল