বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ নভেম্বর ১৯৭১
প্রতিরোধী গেরিলা বাহিনী
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ঘ) মনস্তাত্বিক এবং ত্রাস সৃষ্টিকারী অপারেশন—গেরিলারা জনসাধারণের সহযোগীতা পাওয়ার জন্য এবং তা রক্ষা করার জন্য প্রচারকার্য চালায়। তারা জনগণকে তাদের জাতীয় গৌরবের কথা এবং সরকার ও জনগণের মধ্যে সম্পর্কের অভাবের কথা বলে। তারা দখলকারী সরকারের প্রতি জনগণের অসন্তোষ সৃষ্টির চেষ্টা করে। বেসামরিক কার্য্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ ও সরকারের সঙ্গে সহযোগীতাকে নিরুৎসাহিত করার জন্য গেরিলারা বিধিনিষেধপূর্ণ আদেশ ও নিয়মকানুন মানতে ব্যর্থ হয় তাকে শাস্তি দেওয়া হয় বা হত্যা করা হয়। গেরিলারা সাধারণতঃ দুই একটি কঠোর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে কোন এলাকার বৃহৎগোষ্ঠীকে গেরিলাদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতে আধিপত্য বিস্তার করে।
১। গেরিলারা কোনগোষ্ঠীর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবিশেষকে অপহরণ করে জনগণকে বলা হয় যে যতক্ষণ তারা তাদের সঙ্গে সহযোগীতা করবে ততক্ষণ সেই ব্যক্তির কোন ক্ষতি করা হবে না।
২। যে গোষ্ঠী সরকারের সঙ্গে সহযোগীতা করে বা গেরিলাদের সঙ্গে সহযোগীতা করতে অস্বীকার করে তাদেরকে শাস্তি দেওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে রয়েছে স্থানীয় খাদ্য সরবরাহ নষ্ট করা বা মজুত খাদ্য লুট করা অথবা গ্রাম এলাকা থেকে খাদ্য চলাচল ব্যাহত করা। জন সমাবেশ, যোগাযোগ কেন্দ্র এবং সরকারী অফিসগুলিতে বোমা বিস্ফোরণ করা যেতে পারে। কোন গোষ্ঠীতে অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করার মাধ্যমে অপরাপর জনগোষ্ঠীকে গেরিলাদের সাহায্য করতে বাধ্য করা হয়। সরকারী অফিসার বা সেনাকে হত্যা করে সরকার পক্ষের জনগোষ্ঠীর মধ্যে মৃতদেহ ফেলে রাখা যেতে পারে। এর পিছনে উদ্দেশ্য হলো ঐ জনগোষ্ঠির বিরুদ্ধে সরকারী অনুসন্ধান চলবে এবং তারা শাস্তি পাবে। এই ব্যাপারটিকে গেরিলারা সাংঘাতিকভাবে কাজে লাগিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সাধনে সহযোগী লাভ করবে।
গ) বেসামরিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি—সরকারী কার্য্যক্রম এবং উৎপাদন ব্যাহত করার জন্য ও সরকারী দুর্বলতাকে পরিস্ফূট জনসাধারণের সহযোগীতাকে দুর্ব্বল করার জন্য গোপন ও সাহায্যকারী সংগঠনগুলি শ্রমিক ধর্মঘট, মন্থরগতিতে কাজ করা, প্রতিবাদ সভা করতে পারে। এরকম বিভ্রান্তির আড়ালে শিল্প সম্পদ যন্ত্রপাতি, উৎপন্ন বস্তু এবং কাঁচামাল নষ্ট করা যেতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ও যোগাযোগ নষ্ট করা সরকারী অফিসার ও সামরিক অফিসারকে হত্যা করা যেতে পারে।
ঘ) নাশকতামূলক কাজ—গেরিলারা নাশকতামূলক কাজ করে সরকারের অভ্যন্তরিন নিরাপত্তা ক্ষমতাকে দুর্বল করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে এবং ব্যাপকভাবে পরিচালনা করলে এটা গেরিলাদের একটা অত্যন্ত ফলদায়ক কৌশলে পরিণত হয়। নাশকতামূলক কাজ গেরিলারা প্রকাশ্যভাবে করতে পারে। কিন্তু এটা সাধারণতঃ গেরিলাদের গোপন সংগঠনের কাজ। উদ্দেশ্য এবং এলাকার পরিপ্রেক্ষিতে এর ব্যাপ্তি এবং প্রয়োগ বলতে গেলে ধরা-বাঁধার বাইরে। নাশকতামূলক কার্য্যক্রমের উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে শিল্প, সরকারী অফিস, বিদ্যুৎকেন্দ্র, যন্ত্রপাতি, যাতায়াত ব্যবস্থা, সাধারণ সেবাকাজ কৃষিজাত পণ্য এবং যোগাযোগ নষ্ট করা। নাশকতামূলক কাজ গেরিলাদের কাছে সহজ, কারণ এতে কোন বাঁধাধরা সময়ের প্রয়োজন হয় না এবং হাতের কাছে পাওয়া সরঞ্জামাদি দিয়েই করা যেতে পারে। তার যোগাযোগ, যন্ত্রপাতি এবং রেললাইন ধ্বংস করা সাধারণ ব্যাপার। মাল ও কাঁচামালের ধ্বংসের ব্যাপারে অগ্নিসংযোগ করা হয়। বিল্ডিং, ব্রিজ এবং রাস্তা ধ্বংস করতে বিস্ফোরক ব্যবহার করা হয়।
চতুর্থ অনুচ্ছেদ
শক্তি
গেরিলাবিরোধীদের উপরে গেরিলারা যে সমস্ত সুবিধাদি পেতে পারে তা এই অনুচ্ছেদে আলোচনা করা হচ্ছে।
দখলিকৃত দেশের দুর্বলতা :
দখলিকৃত দেশের অর্থ-নৈতিক, সামাজিক, মনস্তাত্বিক এবং রাজনৈতিক দুর্বলতাসমূহ গেরিলা শক্তির প্রধান উপাদান। এ উৎসবগুলির মধ্যে রয়েছে—
ক) অধিকৃত দেশের সরকারী নীতি এবং জনগণের প্রয়োজন মেটাবার মত পারিপার্শ্বিক অবস্থার অভাব বা অধিকৃত দেশের ক্রিয়াকলাপের ফলে উদ্ভুত পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রতি জনগণের প্রয়োজন অসন্তোষ।
খ) অধিকৃত দেশের সৈন্যগণের মধ্যে পরাজয়ের মনোভাব এবং অধিকাংশ লোকের মধ্যে এ বিশ্বাস যে অভ্যন্তরীণ আক্রমণ সফল হবে গেরিলাদের পক্ষে সমর্থনের একটা ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হলে এরকম মনোভাব প্রকাশ পেতে পারে এবং তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
গেরিলা অপারেশন শক্তির কয়েকটি দিক হলো :-
ক) জনগণের প্রতি সাধারণ সরকারী কর্তব্যসমূহ যেমন, অর্থনৈতিক প্রগতি, নিরাপত্তা ও অন্যান্য আনুসঙ্গিক কাজ পালনের দায়িত্বহীনতা। অবশ্য এ কর্ত্তব্য থেকে গেরিলাদের ঘাঁটি এলাকা ও তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকা বাদ যাবে।
খ) গেরিলা নেতারা উচ্চ প্রশিক্ষণ ও মানসিক প্রস্তুতিপ্রাপ্ত।
গ) সময়সাপেক্ষ বিচারের পদ্ধতি অবলম্বন না করে সরাসরি এবং কার্য্যকরীভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার ব্যবহার।
ঘ) এমন একটা উদ্দেশ্যে আত্মনিয়োগ করা যাকে অনেক গেরিলা ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করতে পারে।
ঙ) গোপন আক্রমণ থেকে খোলাখুলি যুদ্ধে যাওয়ার ব্যাপারে ইচ্ছামত অপারেশন পদ্ধতির বিন্যাস কর।
শেষ
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল