You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ নভেম্বর ১৯৭১

ফেরেনাই শুধু একজন
—বিপ্লবী পথচারী

“প্রয়োজন হ’লে দেব একনদী রক্ত
হোকনা পথের বাধা প্রস্তর শক্ত”
উদাত্ত কন্ঠে সেদিনও এ গানের কলি তাঁর কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল। ভাবতে অবাক লাগে আজ আর তিনি আমাদের মাঝে নেই। নেই বললে ভুল হবে—তিনি আমাদের মাঝে অদৃশ্য শক্তি হয়ে লুকিয়ে আছেন; লুকিয়ে আছেন ভোরের সূর্যালোর রাঙা রংয়ের মধ্যে। মোয়াজ্জেম ভাই কিন্তু এখনো সেই আগের মানুষটি রয়ে গেছেন। এখনো সব সময় মুখের হাসিটি লেগে আছে। চোখের দৃষ্টি যদি রঞ্জক রশ্মির ন্যায় শক্তিশালী হত তা হলে ওঁর বুকের মধ্যে হয়তো অন্য কিছু দেখা যেত। পাওয়ার ফুল চশমাটা চোখে রয়েছে। ট্রাউজারের পরিবর্তে পরনে রয়েছে সবজি রংয়ের প্যান্ট ও সার্ট, মাথায় বাঁধা একই রংয়ের রুমাল। কে বলবে এ সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতা; কে বলবে এ সেই বিশ্ব-বিদ্যালয়ের অর্থনীতির কীর্তিমান ছাত্র! আজ কাঁধে ঝুলছে রাইফেল; হাতে রয়েছে গ্রেনেড; চোখে জ্বলছে আগুন। পাপিয়া দিকে ছাড়া মোয়াজ্জেম ভাইকে আমরা খুব কমই দেখেছি। আজো আমার কানে সেদিনের তীক্ষ্ম স্বরের শপথের কথা গুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। রমনার মাঠে ছাত্র জামায়েতে শেষ ভাষণ শুনেছি পাপিয়াদির। স্বাধীন বাংলার কোন লোক ভুলবে না তাঁকে—ভুলবে না তাঁর আত্মাহুতির মহান আদর্শ; বিস্মৃত হবে না অসমসাহসিক মুক্তি সৈনিকটির বীরত্বের অমর কাহিনী। কত পাতা ঝরা সন্ধ্যা, শিশিরে ভেজা সকাল বাংলার বুকে নব নব রূপে ফিরে আসবে—শুধু একটি লোক থাকবে না আমাদের মাঝে। আর শুনবো না ঘরোয়া আলোচনার পরে এক কোন থেকে ভেসে আসা গানের কলি ‘প্রয়োজন হলে দেব এক নদী রক্ত’! রক্তে দোলা লাগানো সে গানের রেশ আমার মনে এখনো ঘুরপাক খাচ্ছে। বাংলার বুকে আজ অনেক রক্তনদী। অনেক রক্তের স্রোত বয়ে গেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা ও বুড়িগঙ্গার জল আজ রক্তে রাঙা। সে রক্ত নদীর স্রোতে পাপিয়া দির অসমাপ্ত কাজ আমাদের শেষ করতে হবে। আমরা সৈনিক; চোখের জল ফেলে শোক করবো না। খুনের বদলে খুন, রক্তের বদলে রক্ত। প্রাণের পরিবর্তে প্রাণ আমাদের নিতেই হবে। পাপিয়াদির হত্যার বদলা আমরা নেব। তিনি তো বদলা নিয়েই মরেছেন। সুশৃঙ্খল সেনানীর মত নেতৃত্ব দিয়ে শত্রু ছাউনি ধ্বংস করে বীরাঙ্গণার মৃত্যু বরণ করেছেন। যে হানাদার বাহিনী ও দেশী দালালরা বাংলার আকাশ, বাতাস করেছে কলুষিত, শত শত বোনদের ইজ্জত লুন্ঠন, গ্রামের পর গ্রামকে করেছে অগ্নি দগ্ধ তাঁদের আমরা ক্ষমা করবো না, ক্ষমা করতে পারবো না। রক্ত নিয়ে রক্তের ঋণ শোধ করবো। শয়তানের সাথে আমরা শয়তান হয়ে লড়বো; সন্ত্রাসের পরিবর্ত্তে পাল্টা সন্ত্রাস সৃষ্টি করে শত্রুদের চোখের ঘুম কেরে নেব।
মোয়াজ্জেম ভাই সেদিন আমাদের সত্যি কথাই বলেছেন একটা গো-মূর্খ সৈনিকের চেয়ে একজন বুদ্ধিমান সৈনিকের কার্যক্ষমতা অনেক বেশি। কার্যক্ষেত্রে আজ তাই ঘটছে। চার পাঁচ জনার ছোট ছোট মুক্তি যোদ্ধাদের গেরিলা দল বিপুল সংখ্যক হানাদার বাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে দিচ্ছে। হানাদাররা লড়ছে টাকার বিনিময়ে আমরা লড়ছি স্বাধীনতার জন্য। ওরা চাইছে ধ্বংস করতে আমরা চাইছি নূতন করে দেশ গড়তে। সূর্যোদয়ের রং রাঙা, স্বাধীন বাংলার মাটিও আজ শহীদের রক্তে রাঙা। ভেজা মাটির মধ্য দিয়েই জন্ম নেবে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলা দেশে। অনেক আশা আর অনেক আকাঙ্ক্ষা সেখানে লুকিয়ে আছে। দীর্ঘ পথ এখনো সামনে রয়েছে—দুর্গম সে পথ আমরা অতিক্রম করবই; হয়তো মাঝ পথে অনেক ভ্রাতৃপ্রতিম সহযোদ্ধাদের হারাতে হবে। সেজন্য দুঃখ নেই। স্বাধীন বাংলার স্বাধীনতার মূল্য দেবার সৌভাগ্য যারা অর্জন করেছেন ভবিষ্যৎ বংশধরদের কাছে তাঁরা চিরদিন নমস্য হয়ে থাকবেন।
কে জানতো শান্ত শ্যামল বাংলার ছেলেরা কাঁদে না—অশ্রুর পরিবর্তে তাঁদের চোখে জ্বলে প্রতিহিংসার আগুন। ঘোষপাড়া, পটলডাঙ্গা, বদরপুর, মোল্লার হাট, বুড়িগঙ্গার তীরের এসব ছোট ছোট গ্রামগুলো আজ আর কেউ চিনতে পারবে না। সন্ধ্যা বেলা একদিন এখানেও মন্দিরে কাশর ঘন্টা বাজতো, মসজিদ থেকে আজানের পবিত্র আহ্বান ধ্বনিত হত আজ আর তা হচ্ছে না। ব্লাস্ট ফায়ারিং ও বোম্বিং করে গ্রামগুলোকে নর পশুরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বদরপুরে খুলেছে রাজাকার ট্রেনিং ক্যাম্প। মোল্লার হাটে বসেছে হানাদার কুত্তাদের ছাউনি। ২রা নভেম্বর মুক্তি বাহিনীর সভায় স্থির হলো ঐ ঘাঁটি দুটো আক্রমণ করা হবে। মোল্লার হাট আক্রমণের নেতৃত্ব দেবেন পাপিয়া দি আর বদরপুরের ট্রেনিং ক্যাম্প আক্রমণের নেতৃত্ব নিয়েছেন মোয়াজ্জেম ভাই। বুড়িগঙ্গার তীরে নাম না জানা দু দল মুক্তিবাহিনী অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যায়। একটা জমাট বাঁধা কালো ছায়া সব গ্রামগুলোকে গ্রাস করেছে; চতুর্দিকে একটা ভুতরে নিস্তব্ধতা। পাপিয়াদি ও মোয়াজ্জেম ভাই আক্রমণের টেকনিক নিয়ে কিছু আলোচনা করার পর উভয়ে হাসিমুখে বিদায় নিলেন। উত্তরে বদরপুর দক্ষিণে মোল্লার হাট। পূর্ব দিকে বয়ে চলছে কল-কল রবে বর্ষার বুড়িগঙ্গা। চঞ্চলা যুবতীর ন্যায় সদা প্রবাহমান। চেনা অচেনা ভাই বোনদের মর-দেহ বুকে নিয়ে কেঁদে কেঁদে বয়ে চলছে বুড়িগঙ্গা। উত্তর দক্ষিণ দু-দিক দিয়ে আমরা প্রবল ভাবে আক্রমণ শুরু করলাম। মেসিনগান, রাইফেল ও মর্টারের মুহূর-মুহ প্রবল শব্দে নিস্তব্ধ গ্রামগুলো আবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। ঘুমিয়ে পড়া মাটি আবার যেন চেনা পদশব্দে চোখ মেলে তাকাচ্ছে। ভাষাহীন অবোধ্য স্বরে বলে চলছে কবে আবার আমার সোনার বাংলার হীরের টুকরো সন্তানদের বুকে নিয়ে শান্তিতে দিন কাটাব। এ ভাষা সকলের জানা নেই। মুক্তিযোদ্ধারা সর্বনিয়ত শুনতে পায় মূক মাটির এ আর্ত-কান্না! দীর্ঘ সময় চললো প্রবল আক্রমণ। পাক ছাউনিটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত আর একশোর উপর রাজাকার দালাল হয়েছে খতম। ভোর হয়ে এসেছে রক্তে রাঙা রং নিয়ে সূর্য আবার দেখা দিয়েছে পূর্বাকাশে। অভিযান সার্থক কিন্তু শুধু একজন ফেরেনি।
পাক ছাউনি ধ্বংস করে সবাই ফিরেছে কিন্তু পাপিয়া দি ফেরেনি। সকলকে বিপদ মুক্ত করে নেত্রী নিজের মরণকে বরণ করেছেন। ঢাকার রমনার মাঠে আবার আমরা বিজয়োৎসব করবো কিন্তু কোরাস গানের মাঝ থেকে একটা পরিচিত কন্ঠস্বরের অভাব সকলকে বেদনা দেবে। মাথায় গুলিবিদ্ধ পাপিয়াদির মর-দেহ সাথী যোদ্ধারা অশ্রুসিক্ত নয়নে বয়ে এনেছেন। মোয়াজ্জেম ভাইর কোন ভাবান্তর নেই। সাথী যোদ্ধাদের তদারকি করা নিয়ে তিনি ব্যস্ত; নিজের রক্তাক্ত দেহের দিকে তাঁর ভ্রূক্ষেপ নেই। পাপিয়া-দি মোয়াজ্জেম ভাইয়ের স্ত্রী। বিশ্ববিদ্যালয়ের সতীর্থ; সংসার জীবনে সহধর্মিনী; মুক্তি যুদ্ধে সহযোদ্ধা। বুড়িগঙ্গার তীরে উত্তর দিকে বদরপুরের কাছে কবর খোলা হয়েছে। হাতে রাইফেল নিয়ে দলে দলে মুক্তিযোদ্ধারা বীরাঙ্গনা নেত্রীকে সম্মান জানালেন। বিউগলের শব্দ ধ্বনিত হবার সাথে সাথে কবরের উপর মাটি চাপা দেয়া শুরু হল। মোয়াজ্জেম ভাই সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা বড় কবরের উপর ফুল দিলেন—দৃঢ় মুঠিতে রাইফেল ধরে কবরের পাশে দাঁড়িয়ে শপথ নিলেন, যে শপথের ভাষা সব মুক্তি যোদ্ধারাই পরিচিত। বিদায় বেলায় দেখলাম সহধর্মিনী, সহযোদ্ধার কবরের উপর তিনি রেখে গেলেন দু-ফোঁটা চোখের জল!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!