বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৪ নভেম্বর ১৯৭১
যুদ্ধ—কার সঙ্গে কার?
সমগ্র পাক-ভারত সীমান্ত বরাবর সৈন্য প্রস্তুতি দেখা যাচ্ছে। বাঙ্কার খোঁড়া হচ্ছে, দূর পাল্লার কামান বসানো হচ্ছে, আরো কত কি! দু’দেশেরই কর্ণধাররা বিদেশী রাষ্ট্রগুলির সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বিদেশী রাষ্ট্রনায়কদের কাছে অনুরোধ করছেন পাকিস্তানের উগ্র রণোন্মাদনা কমানোর জন্য। অপর পক্ষ পাক রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান বিদেশী রাষ্ট্রগুলির কাছে বলছেন, এই পাক ভারত সমস্যা মিটিয়ে ফেলার একমাত্র পথ যুদ্ধ—অতএব ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সাহায্য দাও। যদিও সে আহ্বানে পৃথিবীর সব বৃহৎ শক্তিগুলোই মুখ ঘুরিয়ে বসে আছে।
এর মধ্যে লক্ষণীয় হচ্ছে ভারত পাকিস্তান উভয়ের বক্তব্যের মূলগত তফাৎ। যেখানে ভারত বলতে চাইছে বাংলাদেশ একটা আন্তর্জাতিক সমস্যা, সেখানে পাকিস্তান বলতে চাইছে ওটা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার, আসল সমস্যা ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। ভারত চাইছে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ এগিয়ে আসুক; পাকিস্তান চায়, পাক-ভারত সমস্যার সমাধানে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ তাকে অস্ত্র দিক। এসব বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় যুদ্ধের গরজটা কার। যে দানব ইয়াহিয়া নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর পশুশক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে মুক্তি বাহিনীর কাছে প্রচন্ড মার খেয়েছে, সেই দানবই এবার নিজের অপমান ঢাকতে মুক্তি বাহিনীর বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই লাগাতে চায়।
ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ হলে কি হবে, তা নিয়ে সামান্য চিন্তাও মুক্তি বাহিনীর, তথা বাঙলাদেশের জনগণের, নেই। কারণ, তাদের উদ্দেশ্য একটিই—বাংলাদেশের চূড়ান্ত স্বাধীনতা। তাই বাঙালী অবাক হয়না যখন সে দেখে আমেরিকা, রাশিয়া, চীন—এই চীন পরস্পরবিরোধী বৃহৎ শক্তি একবাক্যে বলছে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হবে রাজনৈতিক উপায়ে। বাঙালী জানে, রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব ছিঁড়ে ফেলে সে স্বাধীনতা আনবেই।
তাই আজ পাক ভারত যুদ্ধ হোক বা নাই হোক, আসল যুদ্ধ বাঙলাদেশের অভ্যন্তরে চলছে। সে যুদ্ধ কেবল বাঙালী বনাম পাকিস্তানী নয়, সে যুদ্ধ দানবশক্তির সঙ্গে মানবশক্তির। সে যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ—সে যুদ্ধ সাড়ে সাত কোটী বাঙালীর বাঁচার যুদ্ধ। আর, সে যুদ্ধ জয়েরও বেশী দেরী নেই।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল