You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৪ নভেম্বর ১৯৭১

প্রতিরোধী গেরিলা বাহিনী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
(ঘ) যোগাযোগ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অপারেশন—গেরিলারা শত্রুপক্ষের যোগাযোগ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবিরতভাবে আক্রমণ করতে পারে। তাদের যাতায়াতের ব্যাপারে হয়রানি ও বিলম্বিত করাতে পারে বা যাতায়াত একেবারেই বন্ধ করে দিতে পারে। গেরিলাদের বিভিন্ন শাখাকে যোগাযোগ ব্যবস্থার বিভিন্ন অংশ ভাগ করে দিয়ে তা বিপর্যস্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। শত্রুপক্ষের চলাচলকে বিপর্যস্ত করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন সে অনুপাতে প্রতি খন্ডে ব্রিজ এবং রাস্তা ধ্বংস করা যেতে পারে। রাস্তা বন্ধের জন্য প্রায়ই গাছ কেটে রাখা হয় অথচা রাস্তা কেটে এমনভাবে গর্ত করে রাখা হয় যেন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। সাধারণতঃ যোগাযোগ লাইনে গেরিলাদেরকে নিয়োগ করা হয়। তারা গেরিলাবিরোধী ছোট ছোট দলগুলিকে রাস্তা মেরামত বা পরিষ্কার করা থেকে বিরত রাখে। তারা গেরিলাবিরোধীদের সরবরাহ বা সৈন্য চলাচলে ও আক্রমণ চালায়। কোন খন্ডে যদি অধিকতর শক্তিশালী বিরোধীশক্তি লাগানো হয় তবে গেরিলারা সেখান থেকে চলে গিয়ে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী এলাকায় যোগাযোগ বন্ধ করে। সৈন্যদলকে দুর্বল স্থানগুলোতে অনবরত স্থানান্তর করণের ফলে শত্রুপক্ষের যোগাযোগ এমনই বিপর্যস্ত হতে পারে যে তারা শেষ পর্যন্ত সে পথ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয় বা আরও বেশী শক্তি নিয়োগ করে।

(ঙ) Attacks in Force —(শক্তিশালী আক্রমণ) উচ্চমানের সংগঠন সম্পন্ন যথাযথভাবে অস্ত্রসজ্জিত এবং সহায়তাপ্রাপ্ত নিয়মিত গেরিলারা বিচ্ছিন্ন সেনানিবাস, সামরিকদল এবং ঘাঁটির বিরুদ্ধে শক্তিশালী আক্রমণ চালাতে সক্ষম। এই ধরণের অপারেশন প্রচলিত আক্রমণাত্মক অপারেশনের সমপর্যায়ে পড়ে। সাধারণতঃ গেরিলারা লক্ষ্যস্থলগুলোকে আশে পাশের এলাকাগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেষ্টা করে। লক্ষ্যস্থলগামী রেল লাইন এবং তার যোগাযোগ পরিকল্পিত উপায়ে বিপর্যস্ত করা হয়। নিয়মিত গেরিলারা যখন প্রধান আক্রমণে ব্যস্ত থাকে, তখন অনিয়মিত গেরিলারা বা আধা সামরিক ব্যক্তিদেরকে অবতরণ ও নিক্ষেপণ ক্ষেত্রগুলোর ব্যবহার ব্যাহত করা এবং গেরিলা বিরোধী সৈন্য ও সরবরাহকে লক্ষ্যস্থলে প্রবেশ করা থেকে বিরত করা, বিলম্ব করা, বা ধ্বংস করার জন্য নাশকতা ও অতর্কিত আক্রমণের কাজে লাগানো যেতে পারে।

(চ) প্রতিরক্ষা লড়াই—সীমিত বা সাধারণ যুদ্ধের অর্থে যে প্রতিরক্ষা যুদ্ধ তা গেরিলারা খুব কমই করে। এর একটি কারণ এই যে সফল প্রতিরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় যথেষ্ট পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র ও সরঞ্জাম, কামান, ট্যাঙ্ক বিধ্বংসী কামান ইত্যাদি গেরিলাদের অভাব থাকে। আর একটি ব্যাপার হলো গেরিলাদের কাছে কোন একটি বিশেষ ভূখন্ডের নিয়ন্ত্রণ এমন গুরুত্বপূর্ণ খুব কমই হয় যে তারা একটি শক্ত ধরণের যুদ্ধের ঝুঁকি সত্ত্বেও তা রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর থাকবে। গেরিলারা একটি এলাকা রক্ষা করলে তারা তাদের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের নীতি সংশোধন করে প্রয়োজন মিটাবার এবং ঘাটতি পুরাবার জন্য।

১। গেরিলারা মাঝে মাঝে প্রতিরক্ষা কার্য্য অবলম্বন করে বিরুদ্ধ শক্তিকে অনুকূল অবস্থায় পেয়ে তার পশ্চাদ্ভাগ বা পার্শ্বদেশে আক্রমণ চালানোর জন্য। এ সশস্ত্র আক্রমণের মধ্যে রয়েছে Raid, গোপন অতর্কিত আক্রমণ, এবং যোগাযোগ লাইনে, Reserve unit এর উপরে, সাহায্যকারী দল এবং প্রহরারত ফাঁড়ির উপরে আক্রমণ। বিচ্ছিন্ন আক্রমণ কারীরা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বিশেষ, রেডিও পরিবাহক, ড্রাইভার, সংবাদ পরিবাহক ও অন্যান্য লক্ষ্যবস্তুর উপর আক্রমণ করতে পারে। শত্রু এগোনোর রাস্তায় মাইন পাতা যেতে পারে। আক্রমণকারী বিরোধী শক্তিকে বিচ্ছিন্ন করা অথবা তাদের প্রয়াসকে বিভক্ত করার ব্যাপারে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে লক্ষ্যস্থলের আশে পাশের এলাকায় বিপথগামী করণের কার্য্যক্রম জোরদার করা যেতে পারে।

২। গেরিলানিয়ন্ত্রিত এলাকাকে বিরোধীশক্তি প্রবেশের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এবং নিয়মিত গেরিলাদেরকে এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবার সময় দেবার জন্য গেরিলারা প্রতিরক্ষা কার্য্যক্রম চালাতে পারে। গেরিলাদের প্রতিরক্ষা যুদ্ধের চরিত্রগত দিক হলো, নমনীয়তা, গতিশীলতা এবং আক্রমণাত্মক ভাব।

৩। ঘেরাও হয়ে পড়লে বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে গেরিলারা সঙ্গে সঙ্গে একটা নির্দিষ্টস্থানে শক্তি প্রয়োগের চেয়ে অথবা আলাদা হয়ে নিজ নিজ উপায়ে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করতে পারে। যদি দুটি কৌশলই ব্যর্থ হয় তবে জনসাধারণের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বা মিশে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। জনসাধারণের মধ্যে মিশে যাওয়ার ব্যাপারে নিয়মিত গেরিলাদের ক্ষমতা কম। সেইজন্য তারা দলগত অখন্ডতা রক্ষা করে দল হিসাবে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টার করবে। মাঝে মাঝে গেরিলারা সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে ধরা পড়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ও কোন কোন স্থান থেকে পালানোর জন্য।

Populace Control—জননিয়ন্ত্রণ
কোন প্রতিরোধ আন্দোলন জনসাধারণের উপরে বাহ্যিক মনস্তাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার চেষ্টা করে। গেরিলাদের চেয়ে বরং প্রভাবশালী স্থানীয় নেতাদের সংঘবদ্ধ চেষ্টার মাধ্যমে সাধারণতঃ জননিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করা হয়। গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণের মাত্রার উপরে ‍নির্ভর করে গোপন ভাবে বা প্রকাশ্যভাবে এই নেতারা দেশের বিভিন্ন অংশে কাজ করে। প্রতিটি মেয়ে পুরুষ এবং ছেলে মেয়েকে এই উপলব্ধি করানোর চেষ্টা করা হয় যে তারা প্রত্যেকে সংগ্রামের সঙ্গে জড়িত। সমর্থনকারী প্রতিটি ব্যক্তির সময়ের একটি অংশ গেরিলাদের সাহায্যকারী কোন প্রকার কাজে নিয়োজিত করা হয়। জননিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে গেরিলারা যে ব্যবস্থা নেয় তার মধ্যে রয়েছে, বেসামরিক জনগণকে সংগঠিত করা, প্রচার কার্য্য, অসহযোগী ব্যক্তি বা দলকে ভীতি প্রদর্শন ও তাদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি।

(ক) Intelligence—(গোয়েন্দা কার্য্যক্রম) গেরিলাবিরোধী গুপ্তচর, সংবাদ পরিবেশক এবং সহায়তা কারীদের পক্ষ থেকে বিপদের গুরুত্ব বিবেচনা করে গেরিলাদের সমর্থনকারী প্রতিটি ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা ও তাদের সম্বন্ধে রিপোর্টের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরূপ শক্ত গোয়েন্দাবিরোধী কাজ ছাড়াও গেরিলাদের পক্ষে গোয়েন্দা-কর্ম, বে-সামরিক কাজে বিঘ্ন সৃষ্টি, নাশকতা-মূলক কাজে উদ্বুদ্ধকরণ, শত্রুদের সরঞ্জাম ধ্বংসকরণ, নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্যাদি সরবরাহ বা সরবরাহের কাঠে জনগণকে সংগঠিত করা যেতে পারে। (ক্রমশঃ)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!