বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৪ নভেম্বর ১৯৭১
বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি)
বাংলার এক বীর সন্তান খালেদ মুশারফ সাহেব কুমিল্লা অবরোধ কালে আঘাত পাওয়ায় তাঁর সত্বর চিকিৎসার জন্য তাঁকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে বলে এক খবর পাওয়া গেল। আমরা আশায় আশায় দিন গুণব কবে এই মুক্তিনায়ক আবার আমাদের পথ দেখাতে ফিরে আসবেন। তিনি সেদিন আঘাত না পেলে কুমিল্লা শহর আজ মুক্ত হয়ে যেত। কিন্তু তাঁর আর আমাদের অন্যান্য রণনায়কদের চেষ্টা সফল হতে চলেছে খুব সত্বর—পাক বাহিনী পিছু হটছে।
০০০
পাকিস্তানের জঙ্গীচক্র নিরুপায়, মরীয়া হয়ে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধের চক্রান্ত করার চেষ্টা করছে। মুক্তিবাহিনী ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ চায় না। ভারতও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ চায় না। বাঙালীমাত্রই এই যুদ্ধবাজেদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। যুদ্ধের জিগির তুলে বাংলাদেশের মুক্তির প্রশ্নকে আর ধামাচাপা দেওয়া যাবে না। ইসলামের আদর্শ, মুসলিমের আদর্শ, গণতন্ত্র ও মানবতার সমস্ত ছিটেফোঁটা বিসর্জন দিয়ে পাকিস্তানের কবর রচনা করেছে খানসেনা—এই সোনার বাংলায়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পাঞ্জাবী খানসেনার বিরুদ্ধে রুখে উঠবে পাখতুন, বালুচ সিন্ধী—পশ্চিমের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। যুদ্ধ বাধায় নেতারা। যুদ্ধের মাশুল দেয় সাধারণ মানুষ তাদের শরীরের প্রতিবিন্দু রক্ত নিংড়ে দিয়ে। আজ মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত বাংলার চেয়ে বেশী কে আর বোঝে?
০০০
ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই-এ চীনকে মিত্র হিসেবে পাবার কু-আশায় ইয়াহিয়া সাহেব জুলফিকার আলি ভুট্টোকে পাঠিয়েছিলেন পিকিং। কিছুদিন আগে পর্যন্ত ভুট্টো গদী ফসকে গেল দেখে অভিমান করছিলেন প্রেসিডেন্টের ওপর। ওদিকে প্রেসিডেন্ট তো ভুট্টোকে এবার বিদায়ই দেবেন ঠিক করেছিলেন। হঠাৎ দুই পুরনো দুশমনে নতুন মিতালী হয়ে গেল। কারণ? কারণ একটিই—মুক্তিফৌজের ও গণফৌজের হাতে পাকসৈন্যরা প্রচন্ড মার খাচ্ছে। রাজাকাররা মুক্তিফৌজের কাছে দলে দলে আত্মসমর্পণ করছে। খবর ছড়িয়ে গেছে মুক্তিফৌজ রাজাকারদের শান্তিতে থাকতে তো দিচ্ছেইনা বরং যারা সত্যিই মুক্তি ফৌজকে সাহায্য করতে প্রস্তুত তাদের দলেও টেনে নিচ্ছে। এসবের ফলে বাংলার গ্রাম রাজাকারমুক্ত। পাকসৈন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্র, কামান ইত্যাদি ছাড়া চলতে ভয় পাচ্ছে। তাদের মনোবল ভেঙ্গে যাচ্ছে যখন তাদের সঙ্গের রাজাকাররা মুক্তিফৌজে আত্মসমর্পণ করছে। এই সমস্ত খবরে ইয়াহিয়া চঞ্চল। তাই এখন ভারত আক্রমণ করা দরকার। তাহলে তো চীনকে পেলে সুবিধা হয়।
তাই ভুট্টো ও ইয়াহিয়া আবার পরস্পর হাতে হাত মিলিয়ে কাজ শুরু করলেন। মনে দুজনেরই আশা কাজ উদ্ধার হলে অন্যকে শেষ করতে কতক্ষণ। নেতাদের এই চিরাচরিত খেলা। ভুট্টো তাই ইয়াহিয়ার বিশেষ প্রতিনিধি হয়ে গেলেন পিকিং। কিন্তু হায়—পিকিং-ও তো আজ পিং পং রাজনীতিতে মত্ত। ভারতের টীম এসে সবে ঘুরে গেছে। ভুট্টো সাহেব তো ব্যাট হাতে আসেন নি! পাকিস্তানের নিমজ্জমান নৌকোয় পিকিং আজ আর পা বাড়াতে প্রস্তুত নয়। আমেরিকা বলেছে অস্ত্র সাহায্য বন্ধু। চীনের সাধারণ মানুষ মিছিলে বেড়িয়ে পড়েছে বাংলায় অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে জুলফিকারের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনে। এর আগেই উত্তর ভিয়েৎনাম বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে জানিয়েছে অভিনন্দন। চীন সরকার তাই দুএকটা মিষ্টি কথা বলে ভুট্টোকে ফেরৎ পাঠালেন। উপদেশ দিলেন বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমস্যার কথা চিন্তা করতে।
০০০
বঙ্গবন্ধু কি অবস্থায় আছেন তা নিয়ে বাঙালীমাত্রেরই গভীর দুশ্চিন্তা আছে। সম্প্রতি বোঝা গেল জঙ্গীশাহী তাঁকে জীবিত অবস্থাতেই রেখেছে।
অবস্থা খুব বেগতিক। গ্রাম থেকে পাকসৈন্য সরে গেছে। মুক্তিবাহিনী আজ ছাতক কাল সিলেট পরশু মেহেরপুর—একে একে শহর অবরোধ করা শুরু করেছে। এদিকে বিদেশী পত্রপত্রিকা পরিষ্কার জানাচ্ছে এবার ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে পাকসৈন্যকে একাই লড়তে হবে। পূর্ব ও পশ্চিম দু দিকেই লাগবে যুদ্ধ। লন্ডনের সর্বাধিক প্রচারিত পত্র গার্ডিয়ানও একথা লিখেছে—যে গার্ডিয়ান কোনদিনই অতিরিক্ত ভারতভক্তির পরিচয় আগে দেয়নি।
তাই খানসাহেব হঠাৎ গণতান্ত্রিক হয়ে গেছেন। বলেছেন জনগণ বঙ্গবন্ধুর মুক্তি চাইলে তিনি মুক্তি পাবেন। জনা চল্লিশেক বুদ্ধিজীবীকে দিয়ে একটা আবেদনও করিয়ে রেখেছেন তিনি। এবার প্রয়োজন হলে শেষ রক্ষা করতে যদি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিই দিতে হয় তখন চক্ষুলজ্জার কারণ নেই। খানসাহেবের অবস্থা এখন “মা ধরণী দ্বিধা হও” গোছের।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল