You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৭ নভেম্বর ১৯৭১

মুমূর্ষুর আস্ফালন
—মেহেরুন আমিন

একদা বিশ্বের ত্রাস হিটলারকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর অনেক নরপশুই অনুকরণ করতে চেয়েছে এবং তাদের ভয়াবহ পরিণাম হিটলারেরই অনুরূপ বা তার চেয়ে মর্মন্তুদ নাটকে যবনিকাপাত ঘটেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের নরকুল পিশাচ ইয়াহিয়ার ভাবভঙ্গী ও উচ্চারণ মনে করিয়ে দেয় সেও হিটলারের অভিনয়ে মত্ত। রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতা এবং চতুর্দ্দিকের পরাজয়ের গ্লানিকর মুহূর্তে হিটলার পৃথিবীকে শাসিয়েছিল এই বলে যে তার হাতে এমন অস্ত্র আছে যে তার প্রয়োগ বিশ্বের অংশ বিশেষ মুহূর্তে ধ্বংস হবে, কিন্তু হিটলারের সেই উন্মত্ত হুঙ্কারে মিত্র-রাষ্ট্রবর্গ এতটুকু ভীত হয়নি।
নকল হিটলার ইয়াহিয়াও বাঙালী জাতিকে ভয় দেখিয়েছে এই বলে যে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন যখন বসবে তখন “দেশদ্রোহী” শেখ মুজিব জীবিত নাও থাকতে পারে। উদ্দেশ্য একই। বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনী তার এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ উক্তির জবাব দেবারও প্রয়োজন মনে করেন নি। নরপশু আবার বলেছে লাফিগারোর প্রতিনিধিকে যে শেখ মুজিব একজন “ক্রিমিনাল” এবং সে জানেনা যে শেখ মুজিব কোন জেলে আছে। কুলাঙ্গার আত্মতুষ্টির নেশায় বিভোর হয়ে বলেছে যে ফরাসী প্রেসিডেন্ট কি খবর রাখে যে কোন ক্রিমিনাল কোন জেলে থাকে! সে নিজেকে বর্তমান বিশ্বের এক অতি আধুনিক ও সভ্য দেশের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তুলনা করে নিজের শক্তির দম্ভ প্রকাশ করতে প্রয়াস পেয়েছে। বিশ্ববিবেক তার এই জঘন্য উক্তির প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশ স্বভাবতঃই তাদের জাতির জনকের জন্য উদ্বেগাকুল, তবু ইয়াহিয়ার এই দম্ভোক্তি তাদের দৃঢ় প্রতিজ্ঞ চলার পথে কোন প্রতিবন্ধকতাই সৃষ্টি করতে পারেনি।
নরপশু আঘাতের পর আঘাত খেয়ে আজ পরিত্রাণের সম্ভাব্য রাস্তাও খুঁজে পাচ্ছেনা। নিক্সন-মাও আশীর্বাদপুষ্ট এই নকল হিটলার তাই হুমকি ছেড়েছে ভারত আক্রমণ করবে। ভারতের বিরুদ্ধে “জেহাদ” ঘোষণার জন্য ভাড়াটে মোল্লা দল, দৌলতানা-কাউয়ুম-নছরুল্লা-ফফা-ভূট্টো গ্রুপ ও জামাতে ইছলামী ইতিমধ্যেই ইয়াহিয়ার চাকুরী গ্রহণ করে “বক্তৃতা বিক্রী” শুরু করেছে। মিসেস গান্ধী ও মিঃ কোসিগিনের বিরুদ্ধে চরম বিষোদ্গারের মধ্যে “ভারত ধ্বংস” অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়াহিয়া গ্যাং মরিয়া হয়ে কুকুরের শেষ কামড় বসাবার জন্য ভারত-পাক সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে এবং দিনের পর দিন উস্কানীমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ডালকুত্তা নিজে একবার ঘোষণা করেছিল যে “অনুপ্রবেশকারীরা” বাংলাদেশের কোন জায়গা দখল করলে, সে ভারত আক্রমণ করবে এবং সে ‍যুদ্ধ হবে সর্বাত্মক। মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় আজ বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে তাদের প্রশাসন কায়েম করেছে এবং চূড়ান্ত মারের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ওর পরামর্শদাতারাও আজ হালে পানি পাচ্ছেনা। এত সব সতর্কতার মধ্যেও ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের চৌহদ্দীর আঙ্গিনায় বসবাসকারী প্রভুভক্ত “এলসেসিয়ান মোনেম খা” মুক্তিবাহিনীর হাতেই নৃশংস ভাবে নিহত হল। অদূর ভবিষ্যতে দালাল কুকুরদের একই রাস্তায় যেতে হবে।
এত হুঙ্কার, এত তোড়জোড় কিন্তু কোন কিছুই বীর প্রসবিনী বাংলামায়ের সাড়ে সাত কোটি সন্তানকে তাদের আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র টলাতে পারছেনা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দিন আহম্মদ ও প্রধান সেনাপতি কর্ণেল ওসমানী দৃঢ়কন্ঠে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছেন যে স্বাধীনতা স্বীকৃতির মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হবে অন্যথা রণক্ষেত্রেই এর চূড়ান্ত ফয়সালা হবে। দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য নকল হিটলার একদিকে যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে আবার অন্য দিকে আজকাল বেসুরা কথা বলছে। হঠাৎ সেদিন লা-মঁদের প্রতিনিধিকে জানিয়ে দিল যে “সে ‘বিদ্রোহী’ শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেনা। বিচারকরা যদি তাদের সিদ্ধান্তে শেখ মুজিবকে নির্দোষ বলে, তবে সে পরিস্থিতি বিবেচ্য”। প্রবঞ্চক আবার বাংলাদেশকে নিয়ে নূতন প্রবঞ্চনার জাল বুনছে। একথার সাদা অর্থ যে সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানী কাঠামোর মধ্যে তার সঙ্গে একটা মীমাংসার পৌঁছতে হবে। এত রক্ষক্ষয়ের পরও বাঙালী জাতি ও তাদের অবিসম্বাদী নেতা শেখ মুজিবকে ইয়াহিয়া আজও চিনতে পারেনি। এতে আশ্চর্য্য হবার কিছু নেই। মোসাফেক তার নিজ ধর্ম্ম অনুসারেই এগিয়ে চলেছে।
ইয়াহিয়ার হাতে শেষ অস্ত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এরই জোরে গ্যাং আজও পিন্ডীর গদি আঁকড়ে আছে। কিন্তু নরকুল কলঙ্ক জানেনা যে মহান নেতা কোন ধাতুতে গড়া। ওর পূর্বসূরী হিটলার ভয়ঙ্কর দিনগুলোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর্তস্বরে চীৎকার দিয়েছিল সারা পৃথিবীকে লক্ষ্য করে, যে তার নিকট বিশ্ব-ধ্বংসী অস্ত্র আছে। মুমূর্ষু নকল হিটলারও আজ তার আশু ভয়ঙ্কর দিনগুলো লক্ষ্য করে ভীত সন্ত্রস্ত ভাবে চীৎকার দিয়ে চলেছে যে সে ভারত আক্রমণ করবেন। হিটলার বিশ্বধ্বংসী অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেনি এবং নকল হিটলারের ভারত আক্রমণের মহড়ার মধ্যেই তার চরম পরিণতি নিহিত রয়েছে। সে ও তার গ্যাংকে তাদের পূর্বসূরীদের একই পথে ধ্বংস হতে হবে। ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করেনা—তার অবশ্যম্ভাবী পুনরাবৃত্তি অনিবার্য্য।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: <b>Alert:</b> Due to Copyright Issues the Content is protected !!