বিপ্লবী বাংলাদেশ
৭ নভেম্বর ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি
—দিলীপ কুমার দাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
বাংলার বীর গেরিলারা এই অসমসাহসী সৈনিকের নাম শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করে। আজ আর বাংলার পথে ঘাটে ভীত সন্ত্রস্ত হানাদার বাহিনী বের হতে সাহস পায়না। ঔপনিবেশিক পাক সরকার মরণ শয্যায় শেষ মুহূর্তগুলো গুণে চলেছে। (পৃথিবীর বুকে সার্থক গেরিলা তৎপরতার ইতিহাসের সৃষ্টি করেছে ভিয়েতনামের অসমসাহসী মৃক্তি কামী গেরিলা যোদ্ধারা। তাঁদের বীরত্বপূর্ণ রণকৌশলে আজ পঞ্চাশ হাজারের অধিক সুশিক্ষিত মার্কিন সৈন্য নিহত হয়েছে। ভিয়েতনামে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের শোচনীয় অবস্থা দেখেও পাক জঙ্গীশাহী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারছে না) পাক হানাদার বাহিনী তার ভেঙ্গে পড়া অর্থনীতি নিয়ে বাংলার লক্ষাধিক গেরিলা বাহিনীর সাথে আর কদিন যুদ্ধ করতে সমর্থ হবে! বর্বর ইয়াহিয়ার লুটেরা বাহিনী ক্রমান্বয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সৈনিক সুলভ শৃঙ্খলা ও মনোভাব থেকে বিচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। একদিকে নৈতিক বিচ্যুতির মধ্য দিয়ে পাক আক্রমণকারীরা লুটেরা বাহিনীতে পরিণত হয়েছে, অপরদিকে বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা সব রকমের জড়তা কাটিয়ে ক্রমান্বয়ে দুর্জয় সেনাবাহিনীতে পরিণত হয়েছে। অনেকে প্রশ্ন তোলেন, বাংলার সমতল ভূমিতে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনা করা সম্ভবপর কিনা? বাংলাদেশের খাল, বিল, নদী নালা এবং দিগন্ত প্রসারিত মাঠ ঘাট গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে বিশেষ উপযোগী। বাংলাদেশ যে রক্তঝরা ইতিহাসের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে—তার শেষ হবে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আরো অনেক মূল্য দিতে হবে চূড়ান্ত সাফল্য অর্জন করার জন্য। তাই আমাদের মুক্তি যোদ্ধারা আজ সব রকমের ত্যাগ ও তিতিক্ষার জন্য প্রস্তুত।
সাম্রাজ্যবাদকে চিরতরে রুখতে হলে আমাদের ইস্পাতদৃঢ় সংগঠন ও সংহতি গড়ে তুলতে হবে। মুক্তি সেনানীরা যে গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করছে তা সার্থক করে তুলতে হলে একনিষ্ঠ অনুশীলন ও সংযম একান্ত প্রয়োজন—বাংলার তরুণেরা এই পদ্ধতিতেই আজ প্রস্তুত হয়ে মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে পাক হানাদার বাহিনী চীন ও আমেরিকার কাছ হতে পাওয়া আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ও বলীয়ান—সুতরাং ওদের সাথে লড়তে হলে গেরিলা পদ্ধতি ভিন্ন অন্য কোন উপায় নেই। পরিলক্ষিত সহ্য হিসেবে, গেরিলা যুদ্ধেই আমাদের সেনাবাহিনী অধিক সফলতা অর্জন করে চলেছে। মুক্তি যুদ্ধ সার্থক হবার অনেকগুলো স্তর আছে—বাংলার নিরিখে বিচার করলে আমরা এক ঘটমান বাক্যের মধ্য দিয়ে এর যথার্থ রূপটি ধরতে পারবো। যে কোন দেশেই মুক্তি যুদ্ধ সূচিত হোক, যদি সে দেশের জনসাধারণের অকুন্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা না থাকে তা হলে মুক্তিযুদ্ধের সফলতা অর্জন করা খুবই কষ্টকর। মুক্তি যুদ্ধে দেশের সব লোকই অংশ গ্রহণ করেন; কিন্তু সকলেই যেন অনুভব করতে পারে যে, এই মুক্তি যুদ্ধের মধ্যেই নিহিত আছে সকলের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রশ্নটি। একথা আজ সত্য যে জাগ্রত জনগণের প্রতিরোধ ও মুক্তির সংগ্রাম কঠিন কঠোর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত সফলতা অর্জন করবেই। পশু-শক্তির যে কোন বর্বর আক্রমণকে স্বাধীনতাকামী জাগ্রত জনগণ পরাজিত করতে সক্ষম। ভিয়েতনামের সফলতা আমাদের এই শিক্ষাই দিয়েছে। দীর্ঘ ন’ বছর ধরে কঠিন সংগ্রামের পর ভিয়েতনামের অধিকাংশ স্থান আজ মুক্ত—ফরাশী ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের এ এক চরম পরাজয়। ভিয়েতনামের পরলোকগত রাষ্ট্র-প্রধান হো চি মিন বলেছেন—“পিতৃভূমির মুক্তির জন্য প্রয়োজন হলে আমরা হাজার বছর ধরে লড়বো।” গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকে। বাংলাদেশের গেরিলা বাহিনীর সেনানীদেরও আজ এইরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে লড়তে হবে যে, মাতৃভূমির মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য যে কোন মূল্য দিতেই তাঁরা প্রস্তুত। তবে এই যুদ্ধ তাড়াতাড়িও সমাপ্ত হয়ে যেতে পারে যদি বিপ্লবী শক্তির সামর্থ্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চেয়ে অধিক থাকে।
বাংলা দেশে যে জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ ক্রমান্বয়ে পটপরিবর্ত্তন করে জনযুদ্ধে রূপান্তরিত হচ্ছে তখন এই যুদ্ধের শেষ ফলাফল অর্জনে বেশী বিলম্ব নাও হতে পা। সমস্ত বাংলা দেশের বিরাট অঞ্চল গেরিলা বাহিনীর বলা যায় যে মুক্তি বাহিনীর অবাধ বিচরণের এবং সময়োপযোগী আক্রমণ পরিচালনার উপযুক্ত সহায়ক হবে। জলের মধ্যে মাছ যেমন মিশে থাকে এবং অবাধে বিচরণ করে, গেরিলা বাহিনীও বাংলার বিরাট অঞ্চলে অনুরূপভাবে আত্মগোপন এবং আক্রমণ পরিচালনা করতে সমর্থ।
পৃথিবীতে প্রথম গেরিলা যুদ্ধ পরিচালিত হয় স্পেনে। ১৮০৮-১৮১৩ সাল ব্যাপী নেপোলিয়নের দুর্দ্ধর্ষ বাহিনীর সাথে স্পেনের সেনানীরা গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ পরিচালনা করে নেপোলিয়নকে নাজেহাল করতে সমর্থ হয়েছিল। নেপোলিয়নের স্পেন সমস্যাকে ইতিহাসে ‘স্প্যানিশ আলসার’ বলে অভিহিত করা হয়। গেরিলা যুদ্ধের সফলতা নির্ভর করে সুনিপুণ পরিচালনার উপর।
(ক) দেশের মধ্যেই যুদ্ধ পরিচালিত করতে হবে।
(খ) যুদ্ধ কোন নির্ধারিত স্থানে সীমাবদ্ধ থাকবে না।
(গ) সুযোগ ও সুবিধেমত যে কোন জায়গা থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করতে হবে।
(ঘ) সৈনিকদের মনোবল ও চারিত্রিক দৃঢ়তা হবে অতুলনীয়।
(ঙ) সাধারণ দেশবাসী যেন বুঝতে পারে মুক্তি যোদ্ধারা তাদেরই লোক এবং সকলের স্বার্থে সংগ্রাম করছে।
(চ) গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধ কোন একটি বিশেষ জয় বা পরাজয়ের দ্বারা বিচার করা যায় না। প্রয়োজনে পশ্চাদপসরণ করাও গেরিলা যুদ্ধের একটা পদ্ধতি।
(ছ) পাহাড় পর্বত বন জঙ্গলে গেরিলা যুদ্ধের বিশেষ সহায়ক।
(জ) দেশের জনসাধারণের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এই যুদ্ধের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ অস্ত্র স্বরূপ।
বাংলা দেশের ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম ও সিলেট ভিন্ন অন্য কোন অংশ ঘন ঘন ও পাহাড় পর্বতের অবস্থান নেই কিন্তু তা বলে গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে বাংলার সর্বত্র ব্যাপী খাল, বিল, নদনদী, মাঠ ঘাট প্রভৃতিও কম সহায়ক নয়। বিনা অস্ত্রে গেরিলা বাহিনী অনেক খান সেনা জলে ডুবিয়ে খতম করেছে এমন নজীর বাংলা দেশে অনেক আছে। সর্বশেষে চেতনার উৎকর্ষতা, রণকৌশলের নিপুণতা, ত্যাগ ও তিতিক্ষা প্রভৃতি প্রয়োজনীয় গুণাবলী মুক্তি যোদ্ধাদের জয়ের পথ অনেকাংশে সহজ করে দেবে। সুনিশ্চিত জয়ের পথে বাংলার বীর যোদ্ধারা যখন এগিয়ে যাচ্ছে তখন কোন রকমের সমাধানেই তারা আর রাজী হবে না—স্বাধীন বাংলা দেশের প্রতিষ্ঠাই হবে শেষ সমাধান। [ সমাপ্ত ]
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল