You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৭ নভেম্বর ১৯৭১

ইয়াহিয়ার নূতন চাল
জাল “মুক্তিবাহিনী”

২৫শে মার্চের “পার্ল হারবার” সুলভ বিশ্বাসঘাতকের অতর্কিত আক্রমণ ইয়াহিয়ার প্রথম চাল। তার ধারণা ছিল এই প্রচন্ড অতর্কিত ব্লিৎসক্রীগের ধাক্কায় দুর্বল বাঙালীর মনোবল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে।
কিন্তু তা হল না। হল মুক্তিসেনার জন্ম, বাংলাদেশ সরকারের গঠন।
তখন ইয়াহিয়ার দ্বিতীয় চাল হল নিক্সনের অনুকরণে “ইয়াহিয়া ডকট্রিন”। বাঙালীর দ্বারা বাঙালীকে ধ্বংস করো। গুন্ডা, গোঁড়া ধর্মধ্বজী—যারা ইসলাম ধর্মের প্রকৃত বাণীর এক অক্ষরও উপলব্ধি করতে পারেনি; ধনলোভী ইত্যাদি নানাবিধ অবাঙালী এবং বাঙালীর দ্বারা এবং রাজাকারকুল সৃষ্টি করা হল। এরা নানাবিধ অসদুপায় এবং অপকৌশলের দ্বারা বাঙালী জনসাধারণকে পাকিস্তানের পদানত করতে সাহায্য করবে।
এ চালও বুঝি বা ব্যর্থ হয়! তাই ইয়াহিয়া একটি নূতন কৌশল অবলম্বন করেছে। কী সে কৌশল? ইয়াহিয়া লক্ষ্য করেছে যে, মুক্তিবাহিনীর অস্ত্রবলের চেয়ে বহুগুণ বড় বল—জনগণের সহায়তা। সাধারণ মানুষ দেখেছে যে মুক্তিবাহিনী যেখানেই খানসেনাদের বিতাড়িত ক’রে অঞ্চল মুক্ত করতে পেরেছে সেখানেই গ্রামের শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, এবং যেখানেই খান সেনা এবং তাদের তাঁবেদার রাজাকার সেখানেই লুট, ধর্ষণ, হত্যার রাজত্ব। তাই মুক্তিবাহিনী পেয়েছে জনগণের সশ্রদ্ধ সহায়তা।
তাই ইয়াহিয়ার নূতন ফন্দী জালিয়াতি। যেখানে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধের শক্তি প্রবল, সেখানে সে একশ্রেণীর জাল মুক্তিসেনা ছড়িয়ে দিচ্ছে। তারা মুখে বলে তারা মুক্তিসেনা, মুক্তিবাহিনীর অংশ, কিন্তু কাজে তারা করে লুট, ধর্ষণ, হত্যা। ইয়াহিয়ার এই অপকৌশলের লক্ষ্য—মুক্তিবাহিনীকে জনসাধারণের চক্ষে হেয় প্রতিপন্ন করা।
তাই আমাদের সাবধান বাণী—বিশেষতঃ সেই স্থানের জনসাধারণের প্রতি, যেখানে এখনও মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয় নি, যেখানে খানসেনাদের পদাতিক, ট্যাঙ্ক ও বিমানবাহিনীর আধিপত্য—মুক্তি সেনাদের চিনুন!
০ মুক্তিসেনারা কখনও লুটতরাজ করে না, বরং নিরীহ নিরস্ত্র জনসাধারণকে পশ্চিমী লুটেরাদের লুটতরাজ থেকে বাঁচায়। যে মুখে বলে সে মুক্তিসৈনিক অথচ করে লুটতরাজ সে মুক্তিসেনিক নয়—ইয়াহিয়ার গুপ্তচর জাল মুক্তি সৈনিক।
০ মুক্তিসেনারা দেশদ্রোহীদেরও বিনা বিচারে হত্যা করে না, নিরাপরাধ সাধারণ জনগণকে তো করেই না। যারা ইয়াহিয়ার পশুবলে বাধ্য হয়ে দেশদ্রোহমূলক কার্য করে, তাদেরও মুক্তি সৈনিকেরা তৎক্ষণাৎ হত্যা করে না, তাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়, তাদের পাপস্খালন করে দেশপ্রেমিকে পরিণত করার চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা ভূতপূর্ব রাজাকারদের সহায়কে পরিণত করেছে—এই তার প্রমাণ। শুধু, যে স্বেচ্ছায় ইয়াহিয়ার অনুচর হয়ে বহুসংখ্যক বাঙালীকে হত্যা করেছে, বাঙালীর ঘর জ্বালিয়েছে, বাঙালী মেয়েকে ধর্ষণ করেছে, যারা মুক্তি সেনার হাতে বন্দী হয়েও অনুতাপের কোনো নিদর্শন দেখায়নি, বরং প্রমাণ দিয়েছে যে মুক্ত হলেই তারা আবার তাদের পৈশাচিক অত্যাচার শুরু করেছে, কেবল তাদেরকেই মুক্তি সৈনিকেরা বিচারের পর প্রাণদন্ডে দন্ডিত করেছেন। সুতরাং জানুন মুক্তিসৈনিকেরা প্রাণ নিতে জানে, কিন্তু বাধ্য না হলে প্রাণ নিতে চায় না। যে চায় সে মুখে মুক্তিসৈনিক বলে জাহির করলেও জেনে রাখুন সে ইয়াহিয়ার অপকৃষ্ট নতুন চালের দাবাবড়ের একটি বড়ে।
শুধু কথায় নয়, কাজেও যে মুক্তিবাহিনীর আদর্শ মেনে চলে সেই মুক্তিবাহিনীর সৈনিক। তাকে প্রাণপণে সাহায্য করুন, সে আপনারই আপন ভাই। যে লুটতরাজ করে, ধর্ষণ করে, নির্দ্দয় নির্মম হত্যাকান্ডে লিপ্ত হয়, ঘর জ্বালায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা যা ধ্যান জ্ঞান মন্ত্র নয়—সে ইয়াহিয়ার জাল মুক্তিসেনা।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!