You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৭ নভেম্বর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—মোয়াজ্জেম হোসেন

(বরিশাল, ২ নভেম্বর, ১৯৭১)
রাত বারোটা। কিছুক্ষণ আগে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। এখনো পাতা চুঁইয়ে ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়ছে। খবর পেলাম মীরপুরের পায়রা নদীতে হানাদার বাহিনীর গানবোট নোঙর করেছে। আজ রাতে ওটা ঘায়েল করবো। অনেকদিন পরে বাঞ্ছিত সুযোগ এসেছে। আব্বাস ভাই আমাকে আজকের অপারেশনের নেতা নির্বাচিত করেছেন। ১১ নং গেরিলা দলের সর্বকনিষ্ঠ সৈনিক অরিন্দম আমার সহকারী। দশজন গেরিলা উপদলের পুরো দায়িত্ব আজ আমার উপর। বুকটা শঙ্কায় গুর গুর করছে। সৈনিক জীবনে প্রথম বড় দায়িত্ব পালন করতে চলেছি। পারবো তো! রাত ১টার সময় হাতিমারা জঙ্গল থেকে আমরা যাত্রা করবো। এইমাত্র দীপক খবর দিয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে হানাদার পশুরা গ্রাম থেকে কয়েকটা মেয়ে ধরে এনেছে। অরিন্দম এখনি আক্রমণ করতে চায়। রেখা আর বীণার কথা বোধ হয় ওর মনে পড়ে গেছে। পাক পশুদের লালসার শিকার ওর দুটো বোন। ওর চোখে মুখে দেখছি জিঘাংসার ভার, অনেক বলে ওকে বিরত করলাম। আমিওতো অনেককে বিসর্জন দিয়েছি। তুষের আগুনের মত সব জ্বালা বুকে চেপে রেখেছি। মনের সঠিক অবস্থাটা বোঝাবার ভাষাও প্রকাশের শক্তি আমার নেই। বি-এম স্কুলের স্মৃতি ভেসে উঠে। পরীক্ষার ঘন্টা বাজার আগে আমার মনের অবস্থা ঠিক এ রকম হত। আজ বুঝতে পারছি, আব্বাস ভাই, ‘অপারেশনের’ দু-এক ঘন্টা আগে কেন খুব গম্ভীর হয়ে যেতেন। কেন গভীর চিন্তায় বিভোর হয়ে পড়তেন? বনের পাখীগুলো কিচির মিচির করে রাতের প্রহর ঘোষণা করছে। হাত ঘড়িটার দিকে চেয়ে দেখি একটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকী। না, আর দেরি নয়। প্রয়োজনীয় অস্ত্রগুলো আরেকবার ‘চেকআপ’ করে নিলাম সব ঠিক আছে। আব্বাস ভাই শেষ বারের মত নির্দ্দেশ দিয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। সহকারী নেতা অরিন্দমকে ডাকলাম। ওর চোখে মুখে এখনো প্রতিশোধের কঠিন সঙ্কল্প। কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, Don’t be sentimental। আমরা মুক্তি সৈনিক, আরো অনেক কঠিন কঠোর পরীক্ষার মধ্য দিয়ে সার্পিল পথে এগিয়ে চলতে হবে। অদূরের গান বোটের হেডলাইটে নদীর তীর দিনের মত পরিস্কার হয়ে গেছে। জঙ্গলটা অতিক্রম করে অনেকটা পথ ‘ক্রলিং’ করতে হবে তারপর পজিশন নেবার মত জায়গা পাব।

৩রা নভেম্বর, ১৯৭১
সকাল ৮টা। ডায়েরী লেখার মত মনের অবস্থা আমার নেই। তবু লিখে যাচ্ছি প্রতিটি দিনের ঘটনা। ভাষা নেই, ভাব নেই, তথ্য নেই শুধু আছে রক্ত দেয়া নেয়ার হিসাব। কত দিলাম আর কত নিয়েছি। দেনা পাওনা মেলাবার সময় এখনো আসেনি—এখনো অনেক বাকি আছে। আরো দীর্ঘ পথ অতিক্রম করতে হবে। কাজের মধ্যে আমি ভাল থাকি। বিশ্রামের অবকাশ আমার কাছে বিভীষিকা। একা থাকলেই ফেলে আসা দিনগুলোর অনেক স্মৃতি আমার কাছে ভীড় করে দাঁড়ায়। আমারো বাড়ী ছিল, ঘর ছিল, মা বাবা, ভাই বোন সবই ছিল—আজ আর কেউ নেই। এই পায়রা নদীর স্রোতে কোন অজানায় যেন হারিয়ে গেছে। আমি আছি। স্বাধীন বাংলার সৈনিক হিসেবে আমি চিরদিন বেঁচে থাকবো; বেঁচে থাকবো বাংলার জল, বাংলার মাটি, বাংলার আলো হাওয়ার সাথে। কখনো দৃশ্য কখনো অদৃশ্য শক্তি হয়ে। না, এত আবেগ থাকাতো ভাল না। অরিন্দমকে কালকে আমিই তো সতর্ক করে দিয়েছি। গানবোটের কাছাকাছি এসে নারী কন্ঠের আর্তনাদ আর মদ্যপ পশুদের উল্লাস শুনতে পেলাম। এই তো সুযোগ। দুর্বল মুহূর্তে শত্রুকে চরম আঘাত হানতে হবে। বোন কটার কথা ভেবে মনটা বেদনায় ভরে ওঠে! পারলাম না হতভাগ্য বোনদের রক্ষা করতে। নরপশুদের রক্ত দিয়েই বোনদের কলঙ্ক ধুইয়ে মুছে দেবো। আমার নির্দ্দেশ পাবার সাথে সাথে আব্বাস, জলিল, দীপঙ্কর তিনজনে ‘মর্টার শেলিং’ করতে আরম্ভ করল। অব্যর্থ লক্ষ্য। গানবোটটা সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। কয়েকটি আহত নরপশু কূলে লাফিয়ে পড়ে লক্ষ্যহীন ভাবে ফায়ার করতে শুরু করল। উত্তর দিক দিয়ে অরিন্দম এবং দক্ষিণ দিক দিয়ে আমি পাল্টা ‘ফায়ারিং’ করে জবাব দিলাম। কয়েক মিনিটের মধ্যে সব কটি পশু ভাগাড়ে ফেলে দেয়া ষাঁড়ের ন্যায় কাত হয়েছে। আমার বাম দিকের ঝোপে রহমান ছিল ওর সাড়া না পেয়ে গিয়ে দেখি আহত হয়ে পড়ে আছে কিন্তু কোন শব্দ করছে না, পাছে কোন ক্ষতি হয়। ওকে কাঁধে করে ফিরে চললাম আস্তানার দিকে। সার্থক অভিযান সবকজন সহযোদ্ধাকেই ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। আস্তানার কাছাকাছি পৌঁছবার সাথে সাথেই আব্বাস ভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে বলে উঠলেন,“সাবাস জোয়ান”। প্রথম দিনেই সার্থক নেতৃত্ব। আমি কিন্তু বিজয়ের আনন্দ উপভোগ করতে পারলাম না। নাম না জানা বোন কটার কথা মনে পড়ে যায়; নিজের অজ্ঞাতে চোখ দুটো পানিতে ভরে ওঠে!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!