You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.31 | বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১

বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ
(বিশেষ প্রতিনিধি)

আমরা বাংলাদেশের অনেকে ভেবেছি সারা বিশ্ব এখনো আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালোনা কেন? অনেক সরকারই জেনে শুনে বাংলাদেশের মুক্তি সম্বন্ধে উদাসীন যদিও সেসব দেশের মানুষ বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে জানিয়েছে স্বাগত—এর উদাহরণ চীন আমেরিকা ও আরব দেশ। আজ ভিয়েৎনামের সমর্থনে বোঝা গেছে চীন সরকারের একাংশও বাংলাকে মুক্তিকামী দেশ হিসাবে জানতে চায়। আমেরিকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, সিনেটর কেনেডির মত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক তরুণ নেতাও তো বাংলার স্বপক্ষে জোরদার কন্ঠে বলেছেন। তাঁদেরই উদ্যোগে আজ সর্বরকম আমেরিকান সাহায্য সরকারীভাবে বন্ধ হতে চলেছে। আজ সোমালিয়র ফ্লাগ উড়িয়ে সেই জাহাজে আমেরিকা লুকিয়ে অস্ত্র পাঠায় পূর্ববঙ্গে। হায়রে দুর্ভাগ্য! মুক্তি ফৌজের দুটো মাইনে জাহাজখানা উড়েই গেল!
সারা বিশ্বের কথা ছেড়ে দিয়ে দুই একটা ছোট দেশের কথা ধরা যাক। আফ্রিকার কিছু দেশ বাংলাদেশ সম্বন্ধে পরিচিত কমই। ইউনাইটেড নেশনস-এর সম্মেলনে উরুন্ডি দেশের প্রতিনিধি বাংলার এক প্রতিনিধিকে বলেন, “কিন্তু এত ছোট দেশে আপনারা স্বাধীনতা পেলে চালাবেন কি করে?” শোনা গেল উরুন্ডি দেশে আছে পনের লক্ষ মানুষ। বাংলার সাতকোটি মানুষের কথা শুনে ভদ্রলোক অবাক “পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলছিলেন ছোট দেশ বাংলাদেশ।”
আরেকটা গল্প শোনা গেল। পশ্চিমা প্রতিনিধির কুপ্রচার শুনে বিভ্রান্ত আরেক দেশের লোক ভারত পাকিস্তান বিরোধের কথা বলছিলেন। তিনি দুই দেশের ম্যাপ দেখে হতবাক। হাজার হোক পাকিস্তান তো ভারতেরই অংশ। শুনে পশ্চিমা প্রতিনিধি রেগে খুন।

ইউনাইটেড সেনস এ বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত ষড়যন্ত্র ভেদ করে ঢুকে পড়েছিলেন। অধিকাংশ দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে তাঁরা বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের প্রকৃত চেহারা তুলে ধরেছেন। এর ফল হবে সুদূর প্রসারী।

এবারে নোবেল পুরস্কার পেলেন এক মুক্তিযোদ্ধা। আমার আপনারই মত এক স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা। নাম তাঁর হতে পারত অমল সেন বা রহিম শেখ, নাম তাঁর পাবলো নেরুদা। তিনি এক শোষিত দেশ চিলির অধিবাসী। কিন্তু তিনি লিখেছেন বলিভারের গান :

যে কোন রঙ হবে গোলাপ যা তোমার হৃদয়ের পাশে রুইব?
লাল সেই গোলাপ, তাতে তোমার পদ-পাতের স্মৃতি।
সে কেমন হবে হাতগুলি তোর ছাই যাদের অঞ্জলি?
লাল সেই হাতগুলি, তোমার ভস্মে যাদের জন্ম।
আর কেমন যে বীন তোমার মৃত হৃদয়ের?
লাল তোমার প্রাণময় হৃদয়ের বীজ।

একি স্পেনের মুক্তিযোদ্ধার জন্য না আমাদের পঁচিশে মার্চের শহীদের জন্য? অথবা বিখ্যাত মিগুয়েলের গান :

তোমার জাতের চেয়ে ভাস্বর আর দেখিনি,
শিকড় দেখিনি আর কত দৃঢ়, না সৈন্যের হাত আর,
আমি কিছুই দেখিনি তোমার হৃদয়ের মত জীবন্ময়।

আমারই নিশানের রক্তবহ্নিতে আত্মোৎসৃজিত।
চিরন্তন তরুণ, দীর্ঘ অতীতের বিদ্রোহী স্বাধীন মানুষ,
গমের আর বসন্তের বীজে বীজে ঢল-ধোয়া ধারা,
নিহিত ধাতুর মতো খাঁজ খাঁজ অন্ধকার,
প্রতীক্ষমান কোন্ মুহূর্ত্তে তোমার সঙ্গী উঁচাবে।

তোমার মৃত্যুর পর থেকে আমি আর একা নই!
আমি তাদেরই একজন যারা তোমায় খুঁজে ফিরেছে।
আমি তাদেরই যারা পৌঁছবে একদিন তোমার মৃত্যুর প্রতিবিধানে।

তুমি চিনবে আমার পায়ের ধ্বনি তাদের মধ্যে,
যখন তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে স্পেনের বুকে
কেয়নকে চূর্ণ করতে, যাতে কবর থেকে মুখগুলিকে
ফিরিয়ে পাই আমরা।
ওরা জানুক, যারা তোমায় হত্যা করেছে
এর দাম ওরা দেবে রক্ত দিয়ে।
ওরা জানুক, যারা তোমায় যন্ত্রণায় বিঁধেছে
একদিন ওদের দাঁড়াতে হবে আমার মুখোমুখি।
(অনুবাদ : বিষ্ণুদে’র ‘হে বিদেশী ফুল’ থেকে)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল