বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১
মুক্তিবাহিনীর সাধনা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মানুষ এই শিশু দেশের ভার গ্রহণ করছে বিগত ২৫শে মার্চ রাত্রে। বাঙালীর সাধের বাংলাদেশকে মুক্তি যোদ্ধারা তাঁদের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করতে কোন দিন দ্বিধা বোধ করেনি—করবেনা।
বাংলার জনতা আজকে দলমত নির্বিশেষে সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা শুধু বাংলাকে শত্রুর কাছ থেকে মুক্ত করবার আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তাই তাঁরা ২৫শে মার্চ থেকে হাসি মুখে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। অস্ত্র দ্বারা তারা অসংখ্য খানসেনাদেরকে বাংলার পবিত্র মাটিতে নির্মূল করেছে। এদের শত্রু নিধনের অভিযান চলবে যতদিন না এদেশ থেকে সব শত্রুসেনা খতম হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা আরাম আয়েস ত্যাগ করেছে। কোনরকম প্রলোভন এদেরকে এই মুক্তি সংগ্রাম থেকে দূরে সরিয়ে নিতে পারবে না। আজকে তাদের শুধু একটি কথা, একটি ধ্যান, একটি স্বপ্ন—কেমন করে এই সোনার বাংলা থেকে পশ্চিমা নরঘাতকদের বিতাড়িত করা যায়।
বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা রক্ত শপথ নিয়েছে হানাদার মুক্ত করে এই দেশ স্বাধীন বাঙালীর হাতে তুলে দেবে। এই মহান ব্রতকে যারা বানচাল করতে আসবে সে যেই হোক, বিদেশী-স্বদেশী, তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিধাবোধ করবেনা।
কিছু কিছু রাষ্ট্র আজকে রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন তুলেছেন। এর মূলে রয়েছে ইয়াহিয়া সরকার—সে বুঝতে পেরেছে আর বেশীদিন বাংলার পবিত্র মাটিতে টিকতে পারবেনা। তাই বিদেশের দ্বারা রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্ন তুলেছেন। ২৫শে মার্চ পর্যন্ত রাজনৈতিক সমাধানের সুযোগ ছিল। আজ আর রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজন নেই, যেখানে লাখো লাখো লোক ঘরছাড়া হয়েছে, বাংলার অসংখ্য ভাইবোন, মা-বাবা হারিয়ে গেছে, লাখো লাখো লোক ভিটেমাটি সবই হারিয়েছে। এসব কেন হারিয়েছে?—বাংলাকে ভালবাসত বলে। স্বাধীনতার ডাকে সাড়ে সাত কোটি একত্রে সাড়া দিয়েছিল বলে। বাংলার সবুজ মাটিকে বর্বর নরঘাতক বাহিনী লালে লাল করে তুলেছে বলে। সেই লাল রক্তে শপথ নিয়েছে বাংলার মুক্তি পাগল বিপ্লবী জনতা। কোন আপোস নেই—শুধু স্বাধীনতা।
আজকে যারা আপোসের প্রশ্ন তুলেছেন তাঁদের কাছে প্রশ্ন :- বাংলায় যে ঘটনা ঘটেছে আপনার দেশে যদি তা ঘটত আপনারা কি আপোসে রাজি হতেন? জনতা কি মেনে নিতে দিতেন? এর জবাব কেউ দেবেনা, জবাব দিতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধাদের, আপনাদের কাছে আবেদন :- আপোসের প্রশ্ন না তুলে মুক্তি যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়ান।
মুক্তি যোদ্ধারা দিনে দিনে বিজয়ের মালা পরছে। পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই মুক্তি যোদ্ধাদের দমাতে পারে। মুক্তি যোদ্ধারা রক্তের বদলে রক্ত নিতে জেনেছে। এরা যখন একবার অস্ত্র কেড়ে নিতে শিখেছে তখন এদেশ থেকে হানাদারদের তারা দূর করবেই।
মুক্তি যোদ্ধাদের চোখে সেই দিন ঘুম আসবে, যেদিন এই বাংলার মাটিতে একজনও হানাদার সৈন্য থাকবেনা। সেদিন আর বেশী দূরে নয়। মুক্তি যোদ্ধারা কোন রকম ষড়যন্ত্রকে সহ্য করবে না। এখনও সময় আছে, দেশের মুক্তি যুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন। একমাত্র মুক্তি যোদ্ধারা তাদের দেশকে শত্রুকবল মুক্ত করবে।
মুক্তি যোদ্ধারা আপনাদের জানমাল ও শান্তি রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। তাই এদের সাথে খোলা মন নিয়ে সহ-যোগিতা করতে এগিয়ে আসুন। আপনার গ্রাম বন্দরের উৎপন্ন দ্রব্য আপনার এলাকার জনসাধারণের মধ্যে সম্ভব-মত বিতরণ করে দিন। আপনার এলাকার সকল প্রকার দায়িত্ব আপনাকে নিতে হবে। কেউ যদি অনাহারে ও কষ্টে থাকে, আপনার সম্বল থাকলে তাকে সাহায্য করুন। তাকে যদি সাহায্য না করেন তবে আজকের এই মুক্তি আন্দোলন ব্যহত হবে। আজকের সংকট মুহূর্তে সকলকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।
এই ত্যাগ, এই সংগ্রাম, এই সাধনা—এর মধ্যে দিয়েই স্বাধীন বাংলাদেশ স্বার্থক হবে। সারা বিশ্ব তার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীরাই বিশ্বের ইতিহাসের এই বিশাল ঘটনা ঘটাবে।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল