You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.31 | বাঁচার একমাত্র পথ স্বাধীনতা —মৌলানা খাফী খান | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৩১ অক্টোবর ১৯৭১

বাঁচার একমাত্র পথ স্বাধীনতা
—মৌলানা খাফী খান

রক্তপান যে পশুর স্বাভাবিক ধর্ম তাকে অন্যের কাছে জবাবদিহি করতে হয় না। কিন্তু অপর মানুষের রক্তপান আজ আর মানুষের স্বাভাবিক ধর্ম নয়। সুতরাং সে যখন অন্য মানুষের রক্ত শোষণ করতে উদ্যত হয়, তখন তার অজুহাতের প্রয়োজন হয়; কারণ আজ জগতের মানুষ চেতনার যে স্তরে উন্নীত হয়েছে তাতে শোষণ অমানুষিক বলে বিচার করা হয়।
বর্ত্তমান যুগে সভ্য মানুষ বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগের দ্বারা মানুষের প্রয়োজনীয় বস্তুর উৎপাদন বহুগুণে বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই উৎপাদন ক্ষমতার গতি যদি অব্যাহত রাখা হয় তবে এমন অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে যে উৎপন্ন বস্তু সমানভাবে বেঁটে দিলেও কারও অভাব ঘটবে না। একথা আজ যদি বিশ্বের মানুষ জানে। তাই সে এমন একটা জগৎ গড়ে তুলতে চায় যেখানে কোনো মানুষের কারুকে শোষণ করার প্রয়োজন হয় না। এ জগৎ আজ আর অবাস্তব নয়, এ জগৎ আজ সম্ভব।
তাই মানুষ যখন শোষণ হতে দেখে সে তার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এবং তাই যে শোষক সে একের পর এক শুধু হাত দেখিয়ে অন্য মানুষের কাছে প্রমাণ করার প্রয়াস করে যে সে শোষক নয়।
ঠিক এমনি হয়েছে যুগে যুগে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বড় গলায় দুনিয়ার দুয়ারে বলে বেড়িয়েছে তার সাম্রাজ্যবাদ শোষণ নয়। ব্রিটেন তার সাম্রাজ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, অসভ্য মানুষকে সভ্য করেছে, সক্ষমকে আত্মশাসকের দায়িত্ব থেকে মুক্ত করে তার রাজ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেছে। শোষণ কোথায়?
দারিদ্র? যে কর্মঠ সে শ্রমের দ্বারা নিজের দারিদ্র দূর করতে পারে। অতএব যে দরিদ্র শ্রমবিমুখ অলস তাকে শ্রমমুখী করবার একমাত্র উপায় হয়েছে মুহূর্মুহু বেত্রাঘাত।
এই সুশাসনের বিরুদ্ধে যেই আওয়াজ তুলেছে সেই দুর্বৃত্ত। সাম্রাজ্যবাদ বার বার বলেছে দেশের অধিকাংশ লোক চায় শান্তি। মুষ্টিমেয় দুর্বৃত্তরা লোক ক্ষেপিয়ে বিদ্রোহের প্রচেষ্টা করেছে, ওদের বন্দী করো মারো দেশে যাবার শান্তি বিরাজ করবে যখন সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে মানুষ-কৃষক-মধ্যবিত্ত সঙ্ঘবদ্ধ হতে আরম্ভ করলো তখন সাম্রাজ্যবাদের আরেকটি অজুহাত সৃষ্টি হল—কমিউনিস্ট রুশ এই আন্দোলনের পিছনে যাচ্ছে, তাদের উস্কানিতেই এই নতুন আগন্তুকের প্রবেশ।
পাকিস্তানের সুরু থেকেই বাঙালী বুঝতে শিখেছে যে পাকিস্তানের কর্ণধার পশ্চিম পাকিস্থানের শাসকশ্রেণী। তাদের চোখে বাঙালী পাকিস্তানের অধীন জাতি বিশেষ, ঠিক পুরোপুরি পাকিস্তানী নয়। অতএব তারা প্রথম থেকেই জানতে পেরেছে পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙলার বাঙালীর ভবিষ্যৎ কী?
এর মুখোমুখি জবাব দিতে গেলে বলতে হয়—পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য তাদের দিয়ে থুয়ে যদি কিছু উদ্বৃত্ত থাকে তবে বাঙালীকে কিছু দেওয়া যাবে। অতএব হে বাঙালী তুমি কায়মনোবাক্যে পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিকশ্রেণীর সেবা করো’ তাদের তুষ্ট করো।
কিন্তু আগেই বলেছি, শোষক কখনো বলে না যে সে শোষক। তাই জিন্না সাহেব বাঙালীদের বললেন, আমি তোমাদের আশ্বাস দিচ্ছি, আমার গভর্ণমেন্ট পূর্ব পাকিস্তান যাতে তার পূর্ণ বিকাশ প্রাপ্ত হয় তার জন্য সতত সচেষ্ট। সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন, আমি তোমাদের বলছি তোমাদের মধ্যে বিদেশী সংস্থার অর্থপুষ্ট লোকজন রয়েছে।
অর্থাৎ অসাম্যের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা নিরীহ বাঙালীর স্বধর্ম্ম নয়। আওয়াজের পিছনে আছে বিদেশীদের ওস্কানি। সুতরাং অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মাত্রই দেশদ্রোহ।
আজ আর কারো জানা নেই যে যতদিন যাবে ততই পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাঙলাদেশের অসাম্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে—কারণ তাই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনে এত দিন হয়ে এসেছে। যারা পুথিপত্র ঘাঁটেন তাঁরা জানেন যে পাকিস্তানের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রবর্তনের আগে পূর্ববঙ্গের আঞ্চলিক বার্ষিক গড় আয় ছিল ১৩৫১ কোটি টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল ১৩০৪ কোটি টাকা—অর্থাৎ পূর্ববঙ্গের আয় ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে বেশী। কিন্তু দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কল্যাণে পশ্চিম পাকিস্তানের আয় হয়ে গেল ১৯১৪ কোটি টাকা এবং পূর্ববঙ্গ হল ১৯৪৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানের আয় দ্রুত বেড়ে গিয়ে পূর্ববঙ্গের আয়কে ছাড়িয়ে গেল। এই হল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক জিন্না সাহেব কথিত। “পূর্ববঙ্গের পূর্ণ বিকাশ।”
বাংলাদেশের লোকের এ সত্য জানতে পুঁথিপত্রের তথ্য ঘাঁটতে হয়নি। তারা হাড়ে হাড়ে মজ্জায় মজ্জায় জেনেছে এবং বুঝেছে যে শোষক-শোষিতের সম্পর্কে চিরকালই এমনি হয়ে এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুষ্টিমেয় ধনিক শোষক—এবং পূর্ববঙ্গের লোক সাধারণ শোষিত এই জ্ঞান থেকেই পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার উৎপত্তি।
কিন্তু আগেই বলেছি, শোষক কখনও স্বীকার করে না যে শোষিতের বিদ্রোহের কারণ শোষণ। সে প্রচার করে ঐ বিদ্রোহের মূলে অপরের, বিদেশীর উস্কানি।
তাই ইয়াহিয়ার বারবার চীৎকার, পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনের মূলে হলে ভারতের উস্কানি। এ অসত্য বাণীকে প্রতিষ্ঠিত করার মত সাক্ষ্য—এমন কি মিথ্যা সাক্ষ্যও—ইয়াহিয়া দাখিল করতে পারে নি। কারণ তার উদ্দেশ্য সত্যাসত্য প্রমাণ নয়। তার উদ্দেশ্য ভারতকে হয় যুদ্ধে লিপ্ত করে, নয় প্রতিরক্ষার আয়োজনে বাধ্য করে, বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে পাক-ভারত দ্বন্দ্বের ছদ্ম আবরণে আবৃত করা।
এই হীন প্রচেষ্টায় আর যেই বিভ্রান্ত হোক, শোষিত বাঙালী বিভ্রান্ত হবে না। সে জানে পাক-ভারত দ্বন্দ্ব যে রূপই নিক না কেন তার ভবিষ্যৎ তার নিজের হাতের মুঠোয়। তার স্বাধীনতার যুদ্ধ লড়বে সে-ই বাঙলাদেশের বাঙালী। পৃথিবীর যে কোন দেশ তাকে অস্ত্র দিয়ে, রসদ দিয়ে সাহায্য করুক, সে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তা গ্রহণ করবে—কিন্তু তার স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিতে হবে তাকেই, শত্রুর নিতে হবে তাকেই। স্বাধীনতা কেউ কাউকে হাতে তুলে দেয় না—যদি দেয় তবে সে স্বাধীনতার প্রধান গৌরব অর্থাৎ তার নিজের স্বাধীনতা নিজের বাহুবলে অর্জন করা—তা থেকে সে বঞ্চিত হয়। অন্তরে তার থাকে দৌর্বল্য, আত্মবিশ্বাস তার ক্ষুন্ন হয়, কালে সে পরমুখাপেক্ষী হয়।
তাই বলি, ইয়াহিয়ার ধোঁকায় বাঙালী ভুলবে না। ভারত-পাক যুদ্ধ হলেও যা, না হলেও তাই—বাঙলাদেশের ভবিষ্যৎ বাঙলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। সে জানে সে লড়ছে ধনের জন্য নয়, মানের জন্য নয়, সে লড়ছে শোষিতজনের শোষণের অবসানের জন্য, শোষিতকে মুক্ত করে মানুষের অধিকারে প্রতিষ্ঠিত করতে, বাংলাদেশকে মুক্তমানুষের দেশ করে তুলতে। তাই সে অজেয়, তাই তার চোখের দৃষ্টি অভ্রান্ত, স্থির লক্ষ্যে নিবদ্ধ।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল