বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৪ অক্টোবর ১৯৭১
ঢাকা এখন ফ্যাসিষ্টদের কবলে
(দিল্লীর নিউ ওএভ কাগজ থেকে সংগৃহীত/ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
গত ২৮শে সেপ্টেম্বর কলিকাতাস্থ গ্র্যান্ড হোটেলে আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাস্কর স্ট্যানলি টাইগারম্যানের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। ইনি বিশ্বব্যাঙ্ক সংস্থার পক্ষ থেকে পূর্ববঙ্গে কাজ করছিলেন এবং ২৫ তারিখে ঢাকা থেকে ব্যাঙ্কক হয়ে কলিকাতা আসেন। তরুণ চল্লিশোর্দ্ধ টাইগারম্যান তাঁর ঢাকা সফরে খুব বিচলিত মনে হল।
“আমি তো রাজনৈতিক লোক নই” প্রথমেই তিনি বললেন, “আমি আমার পেশার মধ্যেই ডুবে থাকি। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে আমার কোন মতামত থাকবে না। আমি ঢাকা ও পূর্ব বাংলায় যাই ১৯৬৪ সালে বিশ্বব্যাঙ্ক প্রকল্পের ৫টি টেকনিকাল ইনষ্টিট্যুট তৈরীর কাজে : সিলেট, বরিশাল, বগুড়া, রংপুর ও পাবনা, প্রতি জায়গায় একটি। আমার কাজটাও ভালো লাগত এবং খুব তাড়াতাড়ি পূর্ব বাংলার মানুষকেও আমি ভালো বাসলুম। ১৯৬৪ থেকে ১৯৭০ এর মধ্যে আমি ১৬বার পূর্ব বাংলায় গেছি এবং আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমার আমেরিকাতে যত বন্ধু আছে বাংলাদেশে তার চেয়ে কম নেই। এর আগের বার আমি ১৯৭০ এর ডিসেম্বরে ঢাকা গিয়েছিলাম যখন নির্বাচনের ফলাফল সবে বেরিয়েছে এবং বাঙালী সাধারণের নিজভাগ্য নিয়ন্ত্রণের দাবীকে আমি সমর্থন করেছিলাম। আমি সমস্ত সামরিক সরকার ও পুলিশ রাষ্ট্রের একনায়কত্বকে ঘৃণা করি এবং আমি পাকিস্তান সামরিকচক্রের বিষয়ে আমার মতামত গোপন করিনি।”
“২৫শে মার্চ থেকে আমি অত্যন্ত চিন্তিত ছিলাম—বাংলাদেশের আন্দোলন এর সাফল্য নিয়ে এবং আমার ঢাকা ও অন্য জায়গার বন্ধুদের নিয়ে। তাই চার সপ্তাহ আগে আমি আবার পূর্ব পাকিস্তানে রওনা হই। ঢাকা বিমান বন্দরে পৌঁছতেই বুঝলাম অব্স্থা বেশ কঠিন, কারণ সমস্ত যাত্রীকেই খুঁটিয়ে সার্চ করা হল—এবং প্রত্যেকেরই শরীর সার্চও হল এর এক অংশ। তারপর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে যেতেই মুক্তিযুদ্ধের প্রথম চিহ্ন দেখতে পেলুম সেখানেই আসা যাওয়ার প্রতিবারই আমাদের সার্চ করা হত শরীর।”
“ওপরে ওপরে ঢাকা স্বাভাবিক বলা হয়। কিন্তু কোথায় স্বাভাবিকতা? যেখানে মধ্যরাত্রি অবধি ৭০ এর ডিসেম্বরেও আমি দেখেছি শহর প্রাণবন্ত, সেখানে সন্ধ্যে সাতটা থেকে দোকানপাট বন্ধ, রাস্তা নির্জন! তা ছাড়া দিনের আলোয়ও পথে ঢাকার রাস্তায় খুব কম অল্প বয়সী ছেলে দেখা যায়—তরুণী তো প্রায় একটিও না। আমি অন্ততঃ বাঙালী মেয়ে ঢাকার রাস্তায় গোটা সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে একবারও দেখিনি।”
“একদিন কার্য গতিকে কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসে গিয়ে দেখি বিশফুট দেয়াল ও কাঁটাতারের বেড়া উঠে গেছে সেই বাড়ীটির চারপাশে। আমি লাইনে দাঁড়িয়ে দেখি, যে কেউ বাড়ীতে ঢুকছে সবাইকে পাকসৈন্যরা সার্চ করছে—আমাকেও করল। যে কোন সরকারী অফিসেরই আজ এই হাল।”
“আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেছে “তাহলেও মানুষ পাক সৈন্যের জন্য কাজ করছে কেন?” আমি ঢাকায় আমার নিজচোখে দেখা এক দৃশ্য বলি। একটা রাস্তা মেরামত চলছিল বাঙালী মজুর দিয়ে চব্বিশ ঘন্টা ধরে। সত্তর-আশিজন পাকসৈন্য রিভলবার হাতে এবং বেয়োনেট লাগানো রাইফেল হাতে তাদের তদারক করছিল। কোন সামান্যতম গোলমাল হলেই দুচারজন লোককে সরিয়ে ফেলা হয় এবং তারা উধাও হয়ে যায়। অন্যান্য বিদেশী বন্ধু ও আমার বাঙালী বন্ধুরা একই কথা বলল : ঢাকায় সরানো মানেই ঐসব লোককে গুলী করে শেষ করা হয়েছে অথবা তাদের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। ঢাকার সর্বত্র বিশেষতঃ ইউনিভার্সিট পাড়ায় (যেখানে জগন্নাথ হলের ধ্বংস স্তূপ দেখলাম) পাকসৈন্য গাড়ী করে মানুষের দিকে অটোমেটিক বন্দুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সহরের সর্বত্র হাওয়ায় হাওয়ায় সকাল থেকে সন্ত্রাস ভেসে বেড়ায় অদ্ভূত ভাবে। যেকোন স্বাভাবিক পুরুষ বা মেয়ে ঢাকায় কাজ করতে ঘৃণা বোধ করবে। এই যদি ফ্যাসিজম, এই যদি পুলিশ রাষ্ট্র না হয়, তবে এটা কী?”
আমাদের প্রকল্পের অনেক কর্মীকে শেষ করে নেওয়া হয়েছে এবং আমি স্থিরনিশ্চিত কোন স্বাভাবিক মানুষ, কোন গণতন্ত্র বিশ্বাসী, পাক জঙ্গীর জন্য কাজ করতে পারে না। আমি আমেরিকা ফিরে যাচ্ছি এবং আমার স্বাক্ষরিত রিপোর্টে আমি বিশ্বব্যাঙ্ককে এই প্রকল্পের কাজ বন্ধ করতে অনুরোধ করেছি—কারণ এখন এই কাজ চালানো অন্যায় এবং অসম্ভবতো বটেই, আর আমি নিজে তো আমেরিকায় সিভিল রাইটস্ এর পক্ষেও ভিয়েৎনাম যুদ্ধের বিপক্ষে। তাহলে আমি কি করে পাকিস্তানের পুলিশ রাষ্ট্রের জঙ্গী একনায়কত্বের হয়ে কাজ করি? আমি আর কখনো পাকিস্তানে ফিরে যাবো না, যদিও স্বাধীন বাংলা দেশের জন্য কাজ করতে পেলে তাকে আমি সম্মানজনক ও আকর্ষণীয় কাজ করে বরণ করে নেব।”
আমার সময় হয়ে গিয়েছিল। যাবার আগে প্রশ্ন করলুম “বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তোমার কি মনে হয়?” স্থির শান্ত গলায় টাইগারম্যান বললেন “আমি স্বাভাবিক ভদ্রলোক, হিংসা আমি ভালোবাসি না, আমি খুশী হতাম যদি ওখানে রাজনৈতিক সমাধান হত। কিন্তু বিশ্বাস কর, পদ্মায় লালরক্ত অনেক বয়েছে; তাকে এড়িয়ে বাংলার মানুষ সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছু মেনে নিতে পারে না। আবার ইয়াহিয়গোষ্ঠীর শিকারী বাজেরা বাংলাদেশকে ইচ্ছামত স্বাধীন হতেও দেবে না। তাই বাংলাদেশকে স্বাধীনতার জন্য লড়তে হবে, লড়তেই হবে। যদিও তা দশ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং জঙ্গীশাহী সেখানে চলবে না। আমি ঢাকা ও আশেপাশে এক মাসে অনেক বাড়ীতে গেছি। সর্বত্র মানুষ ছেলেবুড়ো মিলে স্বাধীন বাংলা রেডিও শোনে এবং মুক্তিবাহিনীর জয়কে অভিনন্দন জানায়। মৃত্যুহীন এই মুক্তিস্বপ্নকে কে নিরস্ত করতে পারে?”
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল