বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৪ অক্টোবর ১৯৭১
কে কোথায় জানিনা
—মেহেরুন আমিন
চার মাস বিদেশ ভ্রমণ শেষে পঁচিশে মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ফিরি, ছেলেমেয়েরা আমাকে পেয়ে আনন্দে অধীর। ছোট ছেলে সগর্বে জানাল যে আগামীকাল ২৬শে মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রধানমন্ত্রী হবেন। গল্প গুজবে সময়ে কেটে যাচ্ছিল কিন্তু বড় ছেলের মুখে রা শব্দটি নেই। সে শুধু চুপচাপ শুনে যাচ্ছিল আমার বিদেশ ভ্রমণের কাহিনী। হঠাৎ বিকট শব্দ, সৈন্য চলাচল, ট্যাঙ্কের আওয়াজ, মেশিন গানের গুলী মানুষের বুক ফাটা আর্তনাদ আমাদেরকে বোবা করে দিল। বড় ছেলে দ্রুত বেয়ে “মেইন সুইচ” বন্ধ করে বাসা অন্ধকার করে দেয় এবং চারদিকের এই গোলাগুলির মধ্যেই রাস্তায় বেরিয়ে বাইরের লোহার গেটে বিরাট তালা লাগিয়ে “মাঙ্কিগেট” দিয়ে ভিতরে ঢুকে তালা দেয়। সৌভাগ্যক্রমে “মাঙ্কিগেট” দিনের বেলায় বেলায় ও ভাল করে লক্ষ্য করে দেখা যায় না, আর এত রাত্রিকাল।
ঢাকার রমানা এলাকায়ই আমার বাসা। বাসাটি দ্বিতল। হঠাৎ মেসিন গানের গুলি দেয়ালে লাগে এবং পরপর কয়েকটি গুলি এসে পড়ে। আমরা সকলেই তখন একটি সুরক্ষিত কামরার মেঝেতে শুয়ে পড়ি কানে আসতে থাকে অফুরন্ত গোলাগুলির আওয়াজ। ভয়ে ছোট ছেলেটি ও মেয়ে দুটি বেহুস হয়ে পড়ে। কিছুই করবার নেই। ঐ অবস্থায়ই অনেকক্ষণ পর তাদের হুস হয় এবং তারা আমাকে ও তাদের বড় ভাইকে জড়িয়ে ধরে। কয়েকবারই টের পাই সৈন্য ভর্ত্তি গাড়ী বাসার সম্মুখে দাড়াচ্ছে এবং পরক্ষণেই চলে যাচ্ছে। বুঝতে বাকী রইলনা যে বাড়ীর গেটের বড় তালাই এই মুহূর্তে আমাদের রক্ষা কবচের কাজ করছে। আমার বাড়ী হতে প্রায় দু’শ হাত দূরে পর পর কয়েকটি বাড়ী। রাত্রি শেষের দিকে যখন আমরা সবাই তন্দ্রাচ্ছন্ন, সেই সুযোগে বড় ছেলে হামাগুড়ি দিয়ে প্রত্যেকটি রুমের জানালা-দরজার পর্দা খুলে ফেলে এবং এরই মধ্যে সে নীচ তলায় ঢুকে সেখানকারও প্রতিটি জানালা-দরজার পরদা খুলে ফেলে ও নীচ তলার ড্রইংরুমে থাকা টেলিভিসন সেট বাথরুমে রেখে দেয়। কিছু ফুলের টবও ভেঙ্গে এদিক ওদিক ফেলে রাখে। পরে সে দোতলা থেকে বেরুবার গেটে তালা দেয় এবং নিজে পিছন দিক দিয়ে পাইপ বেয়ে ছাদে উঠে টেলিভিশনের তার ইত্যাদি সরিয়ে ফেলে। চোখের পানি আমার ইতিমধ্যেই ফুরিয়েছিল তবুও বড় ছেলেকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে বহু, বহু বৎসর পর ফুফিয়ে কেঁদে উঠি। ছেলে গম্ভীর স্বরে বলে যে “সে শেখ কামালের নিকট পূর্বেই জেনেছিল যে পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী ইয়াহিয়ার হুকুমে আজ রাত্রে ঢাকাকে ‘কারবালা’ করবে এবং গুলীর আওয়াজ ও মানুষের আর্ত্তনাদে তাই হচ্ছে।” গভীর রাত্রের বুকফাটা চীৎকারেই বুঝতে পারি যে অদূরবর্তী বাড়ীর ধন মান ইজ্জৎ লুট হয়ে যাচ্ছে এবং গুলীর আওয়াজে শব্দ স্তব্ধ হচ্ছে। ভোরের দিকে টের পাই কিছু সৈন্য গেট ডিঙ্গিয়ে ভিতরে ঢুকে কিছু মেসিন গানের গুলী খরচ করে তারা চলে গেল। নরপশুর দল ভেবেছে যে অনেক দিন হতেই এ বাসায় লোক নেই। কারণ তখনও শান্তিবাহিনী তথা খাজা খয়েরউদ্দীন বাহিনী গড়ে উঠেনি। সারাদিন একই অবস্থায় ঐ রুমের মেঝেতে পড়ে থাকি। ২৬শে মার্চ দিন ও রাত্রি শুধু জল খেয়েই কাটাই। ২৭শে মার্চ সকালে লোক চলাচল টের পেয়ে ছেলে মেয়েদেরসহ বাসা ছেড়ে এক নিকট আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেই। ২৯শে মার্চ আমার বাসা সম্পূর্ণ লুট হয়ে যায়।
চৌদ্দই এপ্রিল আমরা ঢাকা থেকে ষাট মাইল দূরে এক গন্ডগ্রামে উপস্থিত হই এবং সেখানে পুরো এপ্রিল মাসটিই কাটাই। বড় ছেলে বেশ কয়েকদিন অন্য জায়গায় থেকে ফিরে এসে দৃঢ়তার সঙ্গে দাবী জানায় যে তার সঙ্গে আমাকেও মুক্তি যুদ্ধে যোগ দিতে হবে। স্থির হয় যে আমরা মুক্ত এলাকার উত্তর সেক্টরে চলে যাব। যাত্রার পূর্বে কড়া বিষের ছোট্ট শিশি ও একটি রিভলবার কয়েকটি বুলেট সহ ছেলে মেয়েদের হাতে তুলে দিয়ে বলে—“প্রয়োজন মুহূর্তে তোমরা এ সবই ব্যবহার করবে; সাবধান, জীবন দিবে কিন্তু ইজ্জৎ খোয়াবেনা। চরম প্রতিশোধ না নেয়া পর্য্যন্ত হয়ত আর তোমাদের সঙ্গে আমাদের দেখা হবে না।” ছোট ছেলেটী যেন পাথর হয়ে গেছে, তার আর বলার কিছু নেই। স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে। মেয়েদেরকে তাদের বড় ভাই ছোটবেলা থেকে অসংখ্য সুন্দর ও লোভনীয় জিনিষই উপহার দিয়েছে কিন্তু আজ বিদায় মুহূর্ত্তের উপহারও তারা সমান আগ্রহেই গ্রহণ করল এবং মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। আমাদের সকলের চোখের জলে আমরা পরস্পর থেকে বিদায় নেই।
আজ আমি সেক্টর হাসপাতালে ডাক্তার এবং আমার অতি আদুরে সন্তান মুক্তি যুদ্ধে সাফল্যের সঙ্গে ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যাদেরকে ছেড়ে এসেছি তারা কে কোথায় আছে কিছুই জানি না।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল