You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৪ অক্টোবর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরী
—গোলাম রব্বানী

(পটুয়াখালী থেকে)
নির্জ্জন নদীতীরে বসে ভাবছিলাম জীবনের ফেলে আসা দিনগুলির কথা। কত কথা, কত হাসি, কত গান, আজ সব-সব মনের মণিকোঠা থেকে স্মৃতির তর্পণে ভেসে উঠছে। ছোট্ট সংসার ছিল। মা, বাবা, আর আমরা দুই ভাই। অভাবের তারনায় বাবা দিনরাত সমানে খেটে যেতেন নীরবে। তাঁর কথা ছিল, অভাবের সঙ্গে সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে, নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাছ থেকে চেয়ে পাওয়া যায়না, ছিনিয়ে নিতে হয় আর তার জন্য চাই বাহুবল।” নিদারুণ আর্থিক সঙ্কটের মধ্যেও দিনগুলো কোথা দিয়ে যে কেটে যেতো বুঝতেই পারতাম না। এরপর শুরু হল বর্বরোচিত তান্ডবলীলা। রক্তের বন্যায় ভেসে গেল দারিদ্র নিপিড়িত সংসারটা। হারিয়ে গেল ছোট্ট ভাইটা প্রতিবাদের রণাঙ্গনে। হারিয়ে গেল আমার সংগ্রামী বাবা বেয়নেটের আঘাতে। মাকে আর খুঁজে পেলামনা, হয়ত প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন।
একা বড় একা হয়ে পড়েছিলাম। বাংলার রক্ত পিছল পথে চলতে চলতে হঠাৎ মনে পড়েছিল বাবার কথাগুলো “নিষ্ঠুর পৃথিবীর কাছে চেয়ে পাওয়া যায়না, আদায় করে নিতে হয়।” অধিকার আদায়ের সংগ্রামে জীবন হল উৎসর্গিত। হাতে এল অস্ত্র। তারপর দুর্বার গতিতে জীবন স্রোত এগিয়ে চলল। হঠাৎ রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে একটা প্রচন্ড শব্দ হল। ভাবনাগুলো ঢেউয়ের মত ভাসতে ভাসতে হারিয়ে গেল অনেক-অনেক দূরে—মাথার উপর দিয়ে কয়েকটা পাখী উড়ে গেল ডানা ঝাপটে। উঠে দাড়ালাম। প্রতিক্ষার অবসান হল। সেই সন্ধ্যা থেকে বসেছিলাম ওদের প্রতিক্ষায়। হানাদার আসবে সংবাদ এসেছে অতএব ওদেরকে সাদর সম্ভাষণ জানাতে হবে। মুহূর্তের মধ্যে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। অদূরে প্রতিক্ষ্যমান বন্ধুরাও এগিয়ে এল। ক্যাপ্টেনের নির্দেশ মত আমি এবং অন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা লাইফ জ্যাকেট বেধে গানবোট ধ্বংসী বিশেষ মাইন নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লাম জলের মধ্যে। বাকীরা সবাই নদী তীরে পজিসনে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।
দূরে দেখা যাচ্ছে আলোটা। দ্রুত এগিযে আসছে। আমরাও সাঁতরে এগিয়ে চললাম। একসময় কাছে এগিয়ে এল পাক সৈন্য বোঝাই গানবোটটা। এবার আমার ডুব দিয়ে ‘গানবোটের কাছে চলে গেলাম। এর মধ্যে আমাদের দিক থেকে এল.এম.জি ফায়ার শুরু হয়েছে। গানবোটটা দাঁড়িয়ে পড়ল। শুরু হল গানবোটের ভারী কামানের সেলিং। আমাদের দিকের ফায়ার বন্ধ হয়ে গেল। এমনি মুহূর্তের প্রতিক্ষা করছিলাম আমরা। কেননা ওদের দিক দিয়ে যখন গোলাগুলি শুরু হবে তখন আমাদের দিকের গোলাগুলী থেমে যাবে তখন ওরা ভাববে আমরা পালিয়ে গেছি, ঠিক সেই মুহূর্তে গানবোটের উপর মাইন দু’টো রেখে আসতে হবে।’
নির্দেশ মত আমরা দু’জন গানবোটের পিছন দিকে চলে গেলাম। আর অপেক্ষা নয়। মাইনের পিন দু’টো খুলে গানবোটের নীচে লাগিয়ে দিলাম। সাঁতরে চললাম বিপরীত দিকে। খুব বেশীদূর যেতে পারিনি একটা বিকট শব্দে থেকে পড়তে হল। পিছন দিকে তাকিয়ে দেখলাম দাউ দাউ করে জ্বলছে গানবোটটা।
রাতের অন্ধকার বিদির্ণ করে আগুনের শিখাগুলো উর্দ্ধে মিলিয়ে যাচ্ছে আর আলোয় নদীর জলও লাল রূপ ধারণ করেছে। আমার মনে হল আগুনের লাল নদীর জল লাল করেনি অসংখ্য খান সেনার রক্তে বাংলার নদীগুলো আজ রক্তাক্ত রূপ ধারণ করেছে। রক্তনদী সাঁতরে চললাম তীরের দিকে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!