You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.24 | বঙ্গ আমার জননী আমার —মোহাম্মদ আবদুল হাফিক | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৪ অক্টোবর ১৯৭১

বঙ্গ আমার জননী আমার
—মোহাম্মদ আবদুল হাফিক

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
আমি মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে ঘুরেছি। আজও ঘুরছি। মানুষ তীর্থে তীর্থে ঘোরে। কেননা মানুষ চায় পাপ থেকে মুক্তি। মুক্তিবাহিনীর শিবির আমার মহান তীর্থ। এ-তীর্থ না পেলে আমার জীবনে একটা অপূর্ণতা থেকে যেত। মুক্তিকামী বাঙালী জনগণের মহামুক্তিতীর্থ এই শিবির। আমি বাঙলাকে জানি, বাঙালাকে জানি। স্নেহছায়ায় মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে মানুষ হয় বাঙালীর ছেলে। ক্ষেতের ধান, নদী আর পুকুরের মাছ, চালা বেয়ে ওঠা লাউ-কুমড়োর চারা, একটি গাই, উঠোন জুড়ে ঘুরে-বেড়ানো হাঁস-মুরগী, হাঁটু ভেঙে-পড়া শিশুর হাসি—এইসব নিয়ে বাঙালীর সংসার। বাঙালীর ছেলেরা আজকাল আর দুধে-ভাতে থাকে না বটে কিন্তু মায়ের স্নেহ আজও আছে। সন্ধ্যে হলে মায়ের প্রাণে কান্নার সুর বেজে ওঠে। ছেলে যে তার এখনও ঘরে ফিরে এলো না। সেই বাঙালীর ছেলেরা যুদ্ধ করছে। জোর লড়াই দিচ্ছে। গর্বে বুক ফুলে ওঠে। ওরা ঘর ছেড়েছে, মায়ের স্নেহের বাঁধন কেটে বেরিয়ে এসেছে। তাই বলছিলাম, মুক্তিবাহিনীর শিবির আমার মুক্তিতীর্থ। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করে, দেখে যাও বিশ্ববাসী বাঙালীর ছেলেরা লড়ছে। না ভুল বলছি। মেয়েরাও লড়ছে। মা-বোনেরা লড়ছে। দেখুক পৃথিবী, বাঙালীর ছেলেমেয়েরা অন্যায় আর অসত্যের বিরুদ্ধে বন্দুক হাতে নিয়েছে—শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
ঘুরতে ঘুরতে দেখা হয়ে যায়; দেখা হয়ে যায় জ্ঞানবান দীপশিখাগুলির সঙ্গে। এক হাতে বন্দুক অন্য হাতে লেখনী। কন্ঠে নতুন পৃথিবীর বাণী। একটি শিবিরে সন্ধ্যের পর ওরা আমাকে গান শোনাবার আমন্ত্রণ জানালো। ওরা নিজেরা গান লেখে, গান গায়। না আমার সঙ্গে ওদের কোথাও মিল নেই। আমি তো তথাকথিত বুদ্ধিজীবী। আমি কথা তৈরির কারখানা খুলেছি। কথা বলানোর কারখানা। ওরা কথা বানায় না। ওদের কাজে ও কথায় মিল আছে। আমার মিল নেই। আমি মসী চালাই বটে, কিন্তু অস্ত্রে আমার অধিকার নেই। ওরা অসি ও মসীর দ্বন্দ্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। ওরা সত্য কথাকে সহজ করে বলে। সেজন্যেই ওদের কাছাকাছি হলে আমার সমস্ত গোপন পাপগুলি থরথর করে কাঁপে। ওদেরই একজন কবিতা শুনিয়েছে আমাকে :

ওরা শোষে আজ মোদের খুন
সভ্যকালের যত শকুন।
রক্তলোলুপ হিংস্র শ্বাপদ
বিশ্বশান্তির হুমকি আপদ।
জ্বলছে আগুন পোড়ে চৌদিক
মরেছে বাঙালী দশলক্ষাধিক,
বিছালো মৃত্যুর শীতলাসন
লুটেছে ব্যাঙ্ক রূপা-কাঞ্চন,
ঘরে ঘরে যত ধন-সম্পদ
নারী নির্যাতনও দিলনা বাদ
তরুণ-তরুণী কর জেহাদ।

কবি সৈয়দ আমিনের লেখা এই কবিতা। জল্লাদ পরস্বাপহারী পাকসেনাবাহিনীর একটি সঠিক চিত্রকে তিনি তুলে ধরেছেন। শত্রুর প্রতি প্রচন্ড ঘৃণায় তিনি ফেটে পড়েছেন :

বজ্র আঘাত হানো এবার
বজ্র আঘাত হানে,
মুক্তিসেনারা শত্রু-সেনার
কলজে ধরে টানো।

এমনি আরও একজনের সঙ্গে দেখা। শিবিরের সমবেত সভায় এই তরুণ ভাইটি নিজের লেখা একটি প্রবন্ধ পড়ে শুনিয়েছিল। দুর্গাপূজোর কয়েকদিন আগের কথা। আগমনীর শানাই বাজছে অথচ কোথায় বাঙলাদেশ? অরবিন্দ বিশ্বাস কান্না-ভেজা অক্ষরে অক্ষরে ভরে দিয়েছে তার লেখার পাতা। মাতৃভূমি বাঙলা দেশের উদ্দেশ্যে অরবিন্দ লিখেছিল :
কবির কল্পনা তোমার রূপ বর্ণনা করতে পারে না। চিত্রকর হুবহু তোমার চিত্র অঙ্কন করতে পারেনা। সুজলা সুফলা বাংলা মা তুমি। রূপের তোমার অন্ত নেই। এত থাকতেও তুমি দীনা—কেন, কিসের জন্য? এখন তো বাংলার বুকে শারদীয় উৎসবের শানাই বাজছে না?
না, শারদোৎসবের শানাই নয় ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনী বাজিয়ে চলেছে ধ্বংসের বিষাণ। আর তাই তো অরবিন্দর ঘৃণাগুলি, ক্রোধগুলি, ফেটে পড়েছে, চৌচির হয়েছে। ইয়াহিয়া দোসর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও অরবিন্দের হাতে রেহাই পায় নি। অরবিন্দ ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যে লিখেছে :
বাংলার প্রতিটি গৃহ আজ দুর্গে পরিণত হয়েছে। বাঙালীরা তোমার প্রতিটি সৈন্যকে জ্যান্ত কবর দেবে। তোমার মন্ত্রদাতা নিক্সনেরও ক্ষমতা নেই আর বাংলার মানুষকে দাবিয়ে রাখার।

একথা প্রতিটি মুক্তি সেনার। তাদের চোখে চোখে ঘৃণার মশাল জ্বলছে। কোটি কোটি ঘৃণার মশাল। কবি মুজিবর রহমান বিশ্বাস লিখেছেন :

মনে করছো পিন্ডি বসে
বাঙলা আমি খাবো চুষে
মুক্তিসেনার বজ্রাঘাতে ভাঙবে পিন্ডির সিংহাসন।
জয় বাঙলার নিশাল তুলে
চলছি আমরা দলে দলে
পারবে নারে রুখতে এবার
আসুক যত খান-পাঠান।

এমনিতরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ফলেই মুক্তিবাহিনী আজ শত্রুসেনার ওপর প্রচন্ড আঘাত হেনে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর বীর সেনাদের চিন্তার আলোকেই আমি ওদের চিনতে চেয়েছি। কিন্তু এ-দেখার তো শেষ নেই। ওরা শিবিরে শিবিরে লক্ষ লক্ষ তাজা প্রাণ কলরব করছে। ভাবি, সব শিবিরে কি যেতে পারবো। কিন্তু তা যদি না পারি, আমরা তীর্থভ্রমণ অসমাপ্ত থেকে যাবে। এ যেন এক ভীষণ পিপাসা। তাই বার বার ছুটে যাই শিবিরে শিবিরে। ওরা আমাকে বলেছিল, স্যার আমাদের কথা বলবেন তো? মুখে ওদের কিছুই বলিনি। কিন্তু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি কারো কথা বলি তো ওদের কথাই বলবো। আপাততঃ মেজর জলিলের কবিতার বক্তব্যের সঙ্গে আমি একাত্মতা ঘোষণা করছি :

I will beat the drum and
and beat the drum and I will play
March, march thou march on boys
Enemies you must slay

বাজাব জয়ডঙ্কা আমি বাজাব
বাজাব অবিরত
শত্রুনিধনে সেনাবাহিনী
হও হে সমুদ্যত।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল