বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৪ অক্টোবর ১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি
—দিলীপ কুমার দাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকের দল বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছে একটি উপনিবেশের মত। বাংলাদেশ তার সোনার ভান্ডার কাঁচামালের পরিপূর্ণ করে তোলে আর জঙ্গিশাহী বর্গীর দল লুটের ন্যায় সবকিছু লুটে নেয়। বাংলাদেশের অর্জিত অর্থের দ্বারাই পাকিস্তানের অর্থনীতি নির্দ্ধারিত হয়ে থাকে। পাকিস্তান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে কয়েক সহস্র কোটি টাকা ঋণে আবদ্ধ—আর এই ঋণ শোধ করার একমাত্র উপায় হল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন স্বাধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। যদি বাংলাদেশ তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে সার্বভৌম স্বাধীন দেশ হিসেবে গড়ে ওঠে তা হলে পাকিস্তানের ঘুণধরা অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়বে। ভেঙ্গেপড়া অর্থনীতি নিয়ে পাকিস্তানকে পরিণত হতে হবে আমেরিকার একটি উপনিবেশ। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আজ অখন্ড পাকিস্তানের কথা খুব তারস্বরে ঘোষণা করেছে এবং বাংলাদেশের জল্লাদ ইয়াহিয়া কার্যকলাপকে ঘরোয়া ব্যাপার বলে হাল্কা করে দিচ্ছে। ভারত উপমহাদেশ যেদিন দ্বিধাবিভক্ত হল সেদিন কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী কুকুরের দল অখন্ড ভারতের কথা একবারও উল্লেখ করে নি উপরন্তু জিন্নার সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রগঠনের দাবীকে স্বীকার করে নিয়েছে। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র সমূহ যতই চেষ্টা করুক না কেন তার শোষণ ব্যবস্থা দাঁড়িয়ে রাখতে, কিন্তু ব্যর্থ হতে সে বাধ্য। যে শোষিত জনতার সংখ্যাই হল পৃথিবীতে সর্ববৃহৎ তাঁদের বঞ্চিত করে বেশি দিন সরিয়ে রাখা যায় না ইতিহাস এই শিক্ষাই দিয়ে থাকে। বঞ্চিতের দল তখন বুঝতে পারেন, জীবন-সংগ্রাম থেকে পিছিয়ে পড়লে তাঁদের বাঁচার আর কোন পথ থাকবে না তখন তাঁরা মুক্তি-যুদ্ধের পথে যেতে বাধ্য। বাংলার কোটি কোটি মানুষও দীর্ঘ দিনের লাঞ্ছনা ও গঞ্জনার মধ্য দিয়ে আজ বিপ্লবের পথে যেতে বাধ্য হয়েছেন। পাক জঙ্গীশাহী তার অস্তিত্ব বজায় রাখার পথ হিসেবে বেছে নিল সৈন্যবাহিনী আর তাই সৈন্যবাহিনীর উপর নির্ভরশীলতাই তার অন্তঃসারশূন্য দেউলিয়াপনাকে আরো প্রকট করে তুলেছে। বেয়োনেটের উপর নির্ভরশীল কোন রাষ্ট্র বেশিদিন তার অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে না—বিশ্ব-ইতিহাসে এর অসংখ্য নজির খুঁজে পাওয়া যায়। বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়েই প্রতিরোধের শক্তি জন্ম নেয় এবং শেষ পর্যন্ত প্রতিরোধের শক্তিই জয়লাভ করে কারণ জনগণের দুর্দমনীয় শক্তির কাছে বেয়োনেটের শক্তি পরাভূত হতে বাধ্য। জনযুদ্ধ সূচিত হবার পশ্চাতেও রয়েছে জনগণের জীবনানুভূতি। দেশের সর্বশ্রেণীর মানুষ যখন বুঝতে পারে—নিজের কোন মৌলিক অধিকার নেই তখন থেকেই সে মৌলিক অধিকার অর্জন করার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়। যে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে ভারত ছাড়া করার আন্দোলনকে বাংলার মানুষ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, আজ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদারদের দেশছাড়া করতেও তারা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। একই লোক একই ভাবে বেশিদিন শোষিত হতে চায় না। পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের সার্থক মুক্তিযুদ্ধিই বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামকে আরো শীঘ্র জয়ের পথে নিয়ে যাবে। বেয়োনেটের উপর নির্ভরশীলতাই পাকিস্তানকে প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে অধিক নির্ভরশীল করে তুলেছে। পাকিস্তানের এই নির্ভরশীলতাই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলিকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাখা উপনিবেশ গড়ে তোলার আগ্রহী করে তুলেছে। দক্ষিণ এশিয়ায় এমনি ভাবে সাম্রাজ্যবাদী শোষণ ব্যবস্থার আকস্মিক সুযোগ পেয়ে গেল। শোষণের কবলে পড়ে জাতীয় উন্নতির পথ হল রুদ্ধ এবং পরনির্ভরতা দিনের পর দিন বেড়েই চলল।
বাংলাদেশের মানুষ, মানুষের অধিকার নিয়ে বাঁচতে চায়—এই অধিকারের লড়াই শিল্প, সাহিত্য, ভাষা, জীবিকা প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই ছড়িয়ে পড়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের লড়াই প্রথম সূচনা করেছে বাংলার জনতার মৌলিক অধিকার রক্ষার পদক্ষেপ। একটি জাতির মুখের ভাষা জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া যায় না কিন্তু পাক সরকার বর্বর আক্রমণ চালিয়ে বাংলার মানুষের কন্ঠরুদ্ধ করে দিতে চেয়েছিল কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হল না; হার মেনে নিয়ে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছে। (ক্রমশঃ)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল