প্রতিরোধী গেরিলা বাহিনী
প্রথম অধ্যায়
(প্রথম অনুচ্ছেদ) বিন্যস্তকরণ
আমেরিকান আর্মির AGO 6851A সংখ্যক পুস্তিকাতে ভিয়েৎনাম যুদ্ধের মারফৎ আমেরিকানদের গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে জ্ঞান লিপিবদ্ধ হয়েছে। এক আমেরিকান বন্ধুর মারফৎ এই পুস্তিকা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলাদেশের জনসাধারণের কাজে লাগতে পারে ভেবে আমরা এই পুস্তিকার কিছু অংশ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত করছি। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য, ভিয়েৎনামের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারী মুখপাত্র বাংলার মুক্তিযুদ্ধকে সর্বপ্রকার সহানুভূতি জানিয়েছেন।—সম্পাদক
ভুমিকা : এই অধ্যায়ে নাশকতা ও প্রতিরোধমূলক কতকগুলো প্রতীক সংগঠন ও তাদের কৌশলগত শক্তি, এবং গেরিলাদের সম্বন্ধে সাধারণভাবে আলোকপাত করা হচ্ছে।
এলাকা : সাধারণতঃ গেরিলাদের অপারেশন এলাকার বিস্তৃতি, এ সমস্ত এলাকায় তাদের কার্যকলাপ, এবং গেরিলাদের সেগুলিতে ছড়িয়ে পড়া নির্ভর করে ঐ এলাকায় গেরিলাবিরোধী শক্তির নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার মাত্রা সামগ্রিক উন্নতি, আভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা-প্রচেষ্টার ফলাফল, গেরিলা সেনাবাহিনীর আয়তন ও ক্ষমতা, এবং জনসাধারণের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে কমবেশী হয়। সাধারণত নিম্নরূপভাবে বিভিন্ন এলাকায় গেরিলাদের অপারেশন পরিচালিত হয়।
(ক) গেরিলা-নিয়ন্ত্রিত এলাকা : সাধারণত গেরিলাদের হেড কোয়ার্টার, ক্যাম্প, ও ঘাঁটিগুলি এ সমস্ত এলাকায় থাকে, এবং এগুলিতে বিরোধী শক্তিগুলি প্রবেশ করতে চাইলে দৃঢ়ভাবে বাধা দেওয়া যেতে পারে। গেরিলা ও তাদের সহ সংগঠনগুলি সচরাচর এ সমস্ত এলাকায় প্রচার এবং সংগ্রহ অভিযান চালায়।
(খ) দ্বন্দ্বপূর্ণ এলাকা : এগুলি হলো গেরিলাদের আক্রমণাত্মক অপারেশনের প্রধান এলাকা। এ সমস্ত এলাকায় বিরোধী শক্তিগুলির প্রবেশে দৃঢ়ভাবে বাধা দিতে না পারলেও বদলে তাদেরকে হয়রানি করাই গেরিলাদের কাম্য।
(গ) সহযোগিতাপূর্ণ নিয়ন্ত্রিত এলাকা : এ সমস্ত এলাকায় গেরিলাদের আক্রমণাত্মক অপারেশন সাধারণত রেইড, ছোট খাটো অতর্কিত আক্রমণ, আংশিক ক্ষতি সাধন এবং মাইন বসানোর কাজে সীমাবদ্ধ থাকে। ব্যাটেলিয়ন বা তার চেয়ে বড় দল কর্তৃক সমন্বয় সাধিত আক্রমণের মাধ্যমে গেরিলারা মাঝে মাঝে এ সমস্ত এলাকায় ঢুকতে চেষ্টা করতে পারে। অন্যান্য বিরুদ্ধ কার্যকলাপের মধ্যে রয়েছে গোপন অপারেশন, যেমন, বিপর্যস্তকরণ, গুপ্তচরবৃত্তি, মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন, সন্ত্রাসবাদ এবং অন্তর্ঘাত।
গেরিলা অপারেশন এলাকা : গেরিলারা দখলীকৃত এলাকাসহ তাদের অপারেশন এলাকাটিকে ছোট ছোট খন্ডে বিভক্ত করে এবং এ সমস্ত খন্ডের দায়িত্বভার অধীনস্থ ছোট গেরিলাদের উপরে দেওয়া হয়। এ সমস্ত এলাকায় তারা কৌশলী এবং মনস্তাত্ত্বিক অপারেশন চালনা করে। তারা জনগণকে নিয়ন্ত্রণের এবং কর, খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ সংগ্রহের চেষ্টা করে। এ সমস্ত এলাকার জন্য একটি বিপ্লবী সরকার গঠন করা যেতে পারে। এই সরকারে থাকবে সরকারী পদবীধারী রাজনৈতিক অধিকর্তাগণ এবং থাকবে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ও সামাজিক পৌরসংস্থাগুলো এই অবস্থানুযায়ী দখলকারী সরকারের কাজকে প্রতিস্থাপন করবে। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনিয়মিত, আধাসামরিক এবং নিয়মিত সেনাদেরকে যথাক্রমে স্থানীয়, আঞ্চলিক এবং জাতীয় কাজের ভার দেওয়া হয়, এবং তারা প্রতীক বিপ্লবী সরকারের সম্প্রসারিত অংশ হিসাবে কাজ করে।
বন্টনিকরণ ও অবস্থাপন (Distribution & Location) : বিভিন্ন অপারেশন এলাকায় গেরিলাদের বন্টনিকরণ ও অবস্থান নির্বাচন অত্যন্ত সংনমনীয় ব্যাপার। সেনাদলকে স্থানান্তরিত করাটা শত্রুসেনাকে আক্রমণের সুযোগ করে নেওয়ার জন্যই করা হয়। শত্রু যেন তাদের অবস্থান জানতে না পারে এবং তাদেরকে ধ্বংস করতে না পারে সে জন্য গেরিলা ঘন ঘন ঘুরে বেড়ানোর কৌশল অবলম্বন করে। গেরিলারা তাদের অপারেশন এর বিরুদ্ধে বড় ধরণের বিরোধী শক্তির আসন্নতা দেখলে পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে সাধারণের মধ্যে মিশে যায়।
দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ
গঠন প্রকৃতি
সূচনা : গেরিলা সেনাদলের গঠন নিম্নবর্ণিত বিষয়গুলির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন রকমের হয় যেমন, উদ্দেশ্য, ভূখন্ডের প্রস্তুতি, স্থানীয় জনগণের প্রকৃতি ও বসতি ঘনত্ব, খাদ্যের প্রাচুর্য্যতা, চিকিৎসাবিষয়ক দ্রব্যের সরবরাহ, অস্ত্রশস্ত্র, নেতৃত্বের ধরণ, বাইরের সাহায্য ও নির্দেশের পরিমাণ ও প্রকৃতি এবং প্রতিপক্ষের গেরিলাবিরোধী ব্যবস্থা গ্রহণ।
সংগঠন : গেরিলা সেনাদল সাইজে স্কোয়াড ও প্লাটুন থেকে শুরু করে ডিভিশন বা তার চেয়েও বড় এরূপ দল হতে পারে যা যোদ্ধা, গেরিলা, প্রতিগোয়েন্দা (Counter-intelligence), রাজনৈতিক এবং সরবরাহের সহায়তায় সমৃদ্ধ থাকবে। গেরিলা সেনাদলকে প্রধানতঃ তিন রকমের দলে গঠন করা হয় : নিয়মিত, আধাসামরিক এবং অনিয়মিত। এই শ্রেণীর মধ্যে প্রভেদ মূলতঃ সংগঠন, ট্রেনিং, অস্ত্রশস্ত্র, সরঞ্জাম এবং উদ্দেশ্য সংক্রান্ত।
(ক) জয়লাভের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশী থাকলেই মাত্র নিয়মিত, গেরিলা বাহিনীকে সামরিক উদ্দেশ্যে লাগানো হয়। এই বাহিনীকে ‘প্রধান সেনাবাহিনী’ও বলা হয়। এরা সাধারণতঃ নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় অপারেশন চালনা করে এবং অপারেশন এর প্রয়োজন অনুসারে ও গেরিলা বিরোধী কার্যক্রমের কার্যকরী আর পরিপ্রেক্ষিতে এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় স্থানান্তর করে। নিয়মিত গেরিলাদের থাকে সর্বোৎকৃষ্ট সরঞ্জাম, অস্ত্রশস্ত্র (মর্টার এবঙ আর্টিলারী সহ) ও পোষাক, এবং তাদেরকে প্রথমতঃ গেরিলাবিরোধী নিয়মিত সেনাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়। সাধারণতঃ সুসংগঠিত (রেজিমেন্ট বা তার চেয়ে বড় দল), ভালো ট্রেনিং প্রাপ্ত এবং সুপরিচালিত তারা আধাসামরিক এবং অনিয়মিত গেরিলাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে থেকে কাজ করে। (ক্রমশঃ)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল