You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.17 | মুক্তিযোদ্ধার জীবনলিপি —মুকুল দাস | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৭ অক্টোবর ১৯৭১

মুক্তিযোদ্ধার জীবনলিপি
—মুকুল দাস

(ময়মনসিংহ থেকে)
মা,
নীল দিগন্তটা নীল থেকে নীলান্তরে হারিয়ে যাবে—লাল সূর্যটা আরো লাল হবে—বনশ্রী পুড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে আগুনের লেলিহান শিখায়—সুগন্ধার তীরের সেই ছোট্ট নীড়টা ভাঙ্গনের টানে হারিয়ে যাবে অতল জলের গভীরে—তবু যদি আমি ফিরে না আসি তো দুঃখ কোরনা। কি হবে দুঃখ করে?
জীবনের রঙিন স্বপ্নটার সমাধি হয়ে গেছে মা। সেই সুগন্ধার স্বচ্ছ নীল জল যে আর নীল নেই। অনেক জীবনের রক্ত রাঙায় নীল আজ লালে রূপান্তরিত হয়েছে। ছোট্ট সেই নীড়টা একটা প্রচন্ড ঝড়ে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে গেছে, আর তার সাথে সাথে আশাগুলো ভেসে গেছে সুগন্ধার রক্তস্রোতে।
তাইতো তোমার স্নেহচ্ছায়ায় বন্দী থাকতে পারলাম না। ডাক দিয়েছে আমার দুঃখিনী জননী জন্মভূমি। তাঁকে প্রত্যাখ্যান করা যে মহা অপরাধ। জানি অপরাধী তোমার কাছেও। তবু তোমার কাছে ক্ষমা পাব। তুমি যে আমাকে গর্ভে ধারণ করেছো।
জানো মা, যখন বাংলা মায়ের শ্যামল বনান্তরে ঘুরে বেড়াই মারণাস্ত্র হাতে নিয়ে তখন মনে হয় কে যেন আমার পেছনে পেছনে আসছে, ফিরে তাকাই কিন্তু কাউকে দেখতে পাইনা। শুধু বিশাল অরণ্য থেকে প্রতিধ্বনির মত ভেসে আসে, “বঙ্গ সন্তান, অন্ধকার এ বঙ্গে গিয়ে যাও প্রাণ, অমৃতলোকে পাবে আলোর সন্ধান।”
জানিনা কোথায় সেই অমৃতলোক? জানিনা সেখানেও মানুষ মানুষের অন্ন কেড়ে খায় কিনা—মানুষ মানুষের ইজ্জত নষ্ট করে কিনা—মানুষ মানুষের রক্তে তৃপ্ত হয় কিনা? সেখানেও অধিকারের দাবীতে লাখো লাখো জীবন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে কিনা? কিচ্ছু জানিনা। তবু আলো জ্বালাতে হবে। আলো জ্বালাবার ব্রত নিয়েছি যে—যেহেতু অলক্ষ্যে অমৃত লোক আহ্বান করছে।
একটা সুন্দর দেশ আজ অন্ধকারের অতলান্তে হারিয়ে যেতে বসেছে : সেই দেশের সন্তান আমি অতএব আমার কর্ত্তব্য দেশকে উদ্ধার করা। না হলে ভবিষ্যতের ইতিহাসের কলঙ্করূপে চিহ্নিত হয়ে থাকতে হবে। তাছাড়া জীবনকে যদি দেশের এই বৃহত্তর স্বার্থে উৎসর্গিত না করা যায় সে জীবনের মূল্য কি মা?
সেই যে এতটুকু থেকে এতবড়টি করে তুলেছো কই কোন দিনতো অনুভবেও বুঝতে পারিনি জীবনের মূল্য কি? হয়ত এমনি ভাবেই একদিন জীবনের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে সব হিসেব নিকেশ শেষ হয়ে যেত। এমন জীবনের সত্যি কি কোন মূল্য আছে মা?
জাতির দুর্দিনে—দেশের কল্যাণে যুগে যুগে বহু যুগান্তচারী কালের বুকে পদচিহ্ন রেখে নিঃশেষে জীবন দান করে যদি যেতে পারেন, তবে আমাদের মত তুচ্ছ জীবন কেন পারবনা স্বাধীনতার বেদীমূলে উৎসর্গ করতে?
তাই কেঁদোনা না, আমাদের যাত্রা পথকে অশ্রুনীরে ভিজিয়ে দিওনা মা, সান্ত্বনা দেবার মত কোন আশ্বাসও তোমাকে দিতে পারবনা। নির্যাতিত বাংলার পথে প্রান্তরে ঘুরতে ঘুরতে নিজের অস্তিত্ব আমি হারিয়ে ফেলেছি। হারিয়ে গেছি অনেক তিমিরে। স্বার্থপর পৃথিবীর কান্ড দেখে আমার মন আজ পাথরের মত কঠিন হতে চলেছে। তার প্রয়োজন আছে মা যেহেতু কিছুদিনের মধ্যেই হয়তো আমাকে নিষ্ঠুর পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। মা, তুমি কল্পনাও করতে পারবেনা বিশ্বে আজ বাংলাদেশ নিয়ে কি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র চলছে। লাখো লাখো প্রাণের বিনিময়ে যে বাংলাদেশ পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই লাখো লাখো শহীদের শবের উপর বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে চাপিয়ে দিতে চাইছে, তাই তোমার কাছে আশীর্বাদ চাইছি মা, যেন এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের জাল থেকে আমার জননী জন্মভূমিকে দূরে রাখতে পারি আর নিজেদের শক্তির বলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যকে পৃথিবীর ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে পারি। তার জন্য প্রয়োজনে রক্তের সাগর পেরিয়ে যেতেও যেন আমরা পারি।
—ইতি

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল