You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.17 | তথ্য সংগ্রহ ও অন্য কাজ | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৭ অক্টোবর ১৯৭১

তথ্য সংগ্রহ ও অন্য কাজ

গেরিলা যুদ্ধের যুদ্ধের মূল নীতিই হলো Hit and Run, অর্থাৎ আঘাত করো এবং করেই সরে পড়ো। কিন্তু সাধারণ বুদ্ধিতেই বোঝা যায় যে, শত্রু জোরালো হলে তাকে আঘাত করা সহজ নয়। তখন শত্রুকে প্রথমে দুর্বল করে নিতে হয়, অথবা তার দুর্বলতম স্থান খুঁজে বার করতে হয়। শত্রুকে দুর্বল করে তুলতে হলে তার সংযোগগুলো ছিন্ন করা প্রয়োজন। এ কাজটা অবরোধের পর্যায়ে পড়ে, যা আগেই আলোচনা করা হয়েছে। আর শত্রুর দুর্বলতম স্থান খুঁজে বের করতে হলে চাই শত্রুর সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করা, অর্থাৎ জনসংযোগ। এ সম্বন্ধেও আগে লেখা হয়েছে। এবার আলোচ্য বিষয় হলো ঠিক কোন্ উপায়ে বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী এই ধরণের কার্যকলাপ চালাতে পারে।
প্রথমে তথ্য সংগ্রহের কথাই আলোচনা করা যাক। গ্রামাঞ্চলে তথ্য সংগ্রহ করবে গ্রামবাসীরাই। তাদের সামান্য শিক্ষা দিলেই তারা হানাদার পাকসৈন্যদের সম্বন্ধে খবর যোগাড় করতে পারে। যথা :-
১। ছাউনীর আয়তন ও তার পাহারার ব্যবস্থা, যা থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে মোটামুটি কতজন সৈন্য সেখানে আছে।
২। গাড়ীর সংখ্যা ও সেগুলির সৈন্য বহন ক্ষমতা।
৩। সাধারণতঃ কি ধরণের ও কতো অস্ত্র নিয়ে সৈন্যরা চলাফেরা করে।
৪। পেট্রলের প্রাপ্তিস্থান ও পরিমাণ, যার থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে গাড়ী নিয়ে পাকসৈন্য কতদূর অবধি হানা দিতে পারে।
৬। গাড়ী চলবার মতো রাস্তা কোথায় কোথায় আছে।
৭। জলযান আছে কিনা, এবং থাকলে গাড়ীর মতোই সেগুলো সম্বন্ধেও তথ্য সংগ্রহ।
৮। রসদ আসে কোন পথ দিয়ে, কবে কবে, কখন্ কখন্, এবং তার সাথে কি ধরণের/পরিমাণের প্রহরা থাকে।
৯। ছাউনীর কাছেধারে আড়াল রেখে মুক্তিবাহিনীর লড়াই চালাবার মতো কোনো ঝোপ-জঙ্গল, টিলা-পাহাড়, নদ-নদী আছে কিনা, এবং থাকলে কতো আছে।
১০। মুক্তিবাহিনী কোন্ পথে যাতায়াত করতে পারে, কি ভাবে, এবং কখন।
১১। পাকসৈন্য কখন বিশ্রাম করে বা অসতর্ক থাকে।
এসব তথ্য সংগ্রহ করা একটা অসম্ভব কিছু ব্যাপার নয়। সামান্য নজর রাখলেই দুয়েকজন গ্রামবাসী দশ পনেরো দিনে এই সব খবর জোগাড় করে দিতে পারে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে যে এসব খবর তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে যে এই ‘সামান্য’ খবরগুলো পেলেই মুক্তিবাহিনী পাকসৈন্যের একটা ছাউনী আক্রমণ করতে পারে।
শহরের বাসিন্দাদের পক্ষে তথ্য সংগ্রহের কাজটা এতো সহজ নয়। তাদের জানতে হবে প্রতিটি অস্ত্রের পরিচয় ও ক্ষমতা। এর কারণটা খুবই সহজ। গেরিলাদের বারবার আক্রমণে পাকসৈন্য উত্যক্ত হয়ে উঠলে হয়তো তারা ভারী অস্ত্র এনে গেরিলাদের গোপন-ঘাঁটিসহ একটা বসতি অঞ্চল ধ্বংস করে দিতে পারে। কাজেই শহর অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহকারী কে জানতে হবে, ঠিক কোন্ অস্ত্রের সাহায্যে বাড়ীগুলো ধ্বংস করে দেওয়া যায়। এবং তাদের লক্ষ্য রাখতে হবে হানাদার সৈন্যরা ঐ ধরণের কোনো অস্ত্র সমাবেশ করেছে কিনা। আর যদি তা না করে, তাহলে শুধু পাকসৈন্যের গতিবিধি ও ক্ষমতা সম্বন্ধে খবর সংগ্রহই যথেষ্ট।
এ পর্যন্ত যা বলা হলো তা হচ্ছে শত্রুর দুর্বলতম স্থান খুঁজে বার করা, অর্থাৎ তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে শত্রুর কোথায় জোর কম তা জানা, এবং সেই জায়গাতে শত্রুকে আঘাত করা। প্রথমদিকে আঘাত মানে আত্মরক্ষা, কৌশলশিক্ষা, ও অবরোধ। পরে অবরোধের ফলে শত্রুর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে, শত্রুর রসদ কমে গেলে, এককথায়, শত্রু দুর্বল হয়ে পড়লে, শত্রুকে আঘাত করা সহজ নয়।
“বাংলাদেশে পাক দখলদার সৈন্যদের অবরোধ কিভাবে হবে?”—এ প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুব কঠিন নয়। পাকসৈন্য পুরোপুরি বাইরে থেকে, অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে, আনা রসদ এবং শস্ত্রসম্ভাবেরর সাহায্যে লড়াই চালাচ্ছে। সুতরাং তাদের রসদ আনার পথ বন্ধ করতে পারলেই লড়াই জেতার অর্দ্ধেকটাই হয়ে যাবে। মুক্তিবাহিনীও সঠিক পথেই চলেছে। তারা ইতোমধ্যেই বন্দরগুলো প্রায় অকেজো করে দিয়েছে। ফলে পাকসৈন্য জলপথের সুযোগ আর বিশেষ নিতে পারছেনা। বাকি আছে বিমান যোগাযোগ, এবার সেটা নষ্ট করার ব্যবস্থা দেখতে হবে।
এই ধরণের অবরোধের সাথে নানা জায়গা জুড়ে ছোটো খাটো আক্রমণ করে পাকসৈন্যকে পর্যুদস্ত করে তুলতে হবে। তাতে গ্রামবাসীগণও নিজস্ব ক্ষমতা অনুসারে অংশ গ্রহণ করতে পারেন। কিভাবে তা সম্ভব হতে পারে, সে সম্বন্ধে আলোচনা করা হবে।
মোদ্দা কথা এই, লড়াই যে পর্যায়ে এগিয়ে এসেছে তাতে প্রতিটি সাধারণ মানুষকে হয় তথ্য সংগ্রহ, নয় অন্য পথে মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করতে হবে। কারণ সেটাই স্বাধীনতা লাভের একমাত্র পথ।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল