You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.17 | বাংলাদেশ ও তার নারী সমাজ | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৭ অক্টোবর ১৯৭১

বাংলা দেশ ও তার নারী সমাজ
—অচিন্ত্য কুমার ঘোষ

যুগে যুগে বিশ্বের মাঝে পুরুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে নারীরা। আর তার ফলে পুরুষের হস্ত হয়েছে আরও সুদৃঢ়, আরও অটুট। পুরুষের বিভিন্ন বিজয়ে নারীর দান অপরিসীম। আগেরকার দিনগুলোর চেয়ে আজকালকার নারীরা প্রকাশ্যে পুরুষকে সহযোগিতা আর সাহায্য করছে। আগেকার দিনের নারীরা গৃহের অভ্যন্তরে থেকে পুরুষকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। আর এখন তারা চার দেওয়ালের গন্ডির বাইরে এসে পুরুষের হাতে হাত রেখে সমান তালে এগিয়ে চলেছে যে কোন কঠিন আর কষ্টসাধ্য কাজকে বরণ করতে।
যুগের এই তালে বাংলা দেশের নারীরা পিছিয়ে নেই। তাদের হাতে আজ হাতিয়ার। চোখে শত্রু হত্যার দীপ্ত শপথ আর বুকে অদম্য আশা—সব মিলে তাকে একটা প্রকৃত সৈনিকে পরিণত করেছে। বাংলাদেশের নারীদের এই ভূমিকা শুধু যে ২৫শে মার্চের পরে দৃষ্টি গোচর হয়েছে তা নয়। যেদিন থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী দালাল আর পুঁজিপতিরা মুখের নল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়ে শোষণ করতে আরম্ভ করেছিল সেদিন থেকেই বাংলার মা বোনেরা কড়া প্রতিবাদ করেছে জংগী সরকারের কাছে। আর তার ফল যা হয়ে থাকে তাই হয়েছে। শত শত নারীকে গুলির সামনে জীবন দিতে হয়েছে। বিনা বিচারে জেল খাটতে হয়েছে। তবুও তাদের পা পিছলে যায়নি, বরং আরও শক্ত হয়েছে।
কোলের বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে গুলির সামনে জীবন দিয়েছে বোন আনোয়ারা।
শেখ সাহেবের আহ্বানে যখন সারা বাংলাদেশে হরতাল আর সত্যাগ্রহ চলছে তখন বাংলার শহর গঞ্জে গ্রামে, অলিতে গলিতে কালো পতাকা হাতে নিয়ে মিছিলের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে নারীরা। শ্লোগান দিয়েছে তারস্বরে—“ইয়াহিয়ার আদেশ—মানিনা, মানিনা, জয় বাংলা।” তাদের তখনকার সেই অগ্নি মূর্ত্তি দেখলে কে বলবে এরা নারী? কে বলবে এরা গৃহের অভ্যন্তরে থাকে?
২৫শে মার্চের পরে দেখেছি বাঙালী নারীর বীরত্ব। বুকে মাইন বেঁধে শত্রুর ট্রাঙ্কের তলায় জীবন দিয়ে রওশন আরা বাংলাদেশের নারীদের প্রকৃত সাহস প্রকাশ করে দিয়ে প্রমাণ করে গেছে যে শত্রুর সাথে সম্মুখ সমরে লড়তে বাঙলার নারী সমাজ প্রস্তুত। বিশ্বের ইতিহাসে বীরাঙ্গনা নারীদের সারিতে রওশন আরা একটি উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক।
যে মায়েরা ঘরে থাকত পুত্র, কন্যা স্বামী নিয়ে সুখে, তাদের সেই সুখের ঘরে আগুন দিয়েছে ইয়াহিয়ার পশু সৈন্যরা আর সেই পোড়া ছাই এর উপর ছটফট করে মরেছে অসংখ্য মহিলা। হাজার হাজার নারী তার সতীত্ব হারিয়েছে পশুদের হাতে। প্রিয়জন হারানোর বেদনায় কেউবা হয়েছে পাগল। সেই দুঃখ-ব্যথা ভোলার জন্য বাংলার মা বোনেরা হাতে হাতিয়ার নিয়ে মুক্তি যোদ্ধা হয়েছে। গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করতে গেলে নারীদের ভূমিকা অল্প নয়। তাই লাখ লাখ নারী আজ সাহায্য করছে মুক্তিবাহিনীকে। কেউবা ক্লান্ত, শ্রান্ত, আহত মুক্তি যোদ্ধা এবং গুলিবিদ্ধ অসামরিক লোকদের সেবা করছে। কেউবা তাদের বুকে বল আর সাহস দিচ্ছে, স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে শেখ সাহেবের ইস্পাত কঠিন শপথের কথা। আবার কেউবা গোপনে শত্রু ছাউনির আশে পাশে গিয়ে তাদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তি বাহিনীকে সরবরাহ করছে। আর তার ফলে মুক্তি বাহিনী অতি সহজে দক্ষতার সাথে শত্রু খতম করতে পারছে। বাংলার এই ক্রান্তি লগ্নে বাংলার নারীরা নির্বাক দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকতে পারেনা। বাংলার মা বোনেরা চায় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। অত্যাচারী পশুদের খতম করবার জন্যই তো আপন সন্তানদের হাতে রাইফেল বুলেট দিয়ে রণাঙ্গনে পাঠাচ্ছে। হানাদার খতম করে ফিরে এলে মার বুক গর্বে ভরে ওঠে। বীর সন্তানকে স্নেহভরে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খান। মুক্তি বাহিনী যেদিন সাফল্যের শীর্ষ স্থানে পৌঁছাবে সেদিন বোধ করি বাংলার নারী সমাজই বেশী সুখী হবে। কারণ বর্বর পাকফৌজ তাদের চোখের জল ঝরিয়েছে বেশী কেননা তাদের কেউবা হারায়েছে স্বামী, কেউবা হারিয়েছে সন্তান এবং প্রিয়জন।
তাইতো বাংলার এই দুর্দ্দিনে বাংলার মা বোনেরা শক্ত করে হাল ধরে, কঠিন মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে। মায়েদের চোখের জল, বোনদের রক্ত কখনও বিফলে যাবে না—যেতে পারে না। ওদের মুখে হাসি ফুটবেই এবং তার আর দেরী নেই।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল