You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৭ অক্টোবর ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা পদ্ধতি
—দিলীপ কুমার দাস

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ ক্রমান্বয় সফলতার মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলেছে। প্রথম দিকে এই যুদ্ধ যখন শুরু হয় তখন ছিল একতরফা আক্রমণ, কারণ প্রথম ধাপের আন্দোলন ছিল অসহযোগ—সে আন্দোলনের মধ্যে কোনরূপ সশস্ত্র প্রস্তুতি ছিল না। পৃথিবীর বিভিন্ন মুক্তিকামী দেশগুলোর সংগ্রাম এবং জয়লাভের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে কায়েমী স্বার্থের কাছ থেকে কোনদিন ক্ষমতা আপোসের মাধ্যমে লাভ করা যায় না। পৃথিবীর সব শোষক এবং সাম্রাজ্যবাদীদের নীতি একই কায়দায় বিভিন্ন দেশে পরিচালিত হয়ে থাকে। একটু গভীরে গিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে এই শোষণ এবং নিষ্পেষণ পরিচালনার জন্য একটি কেন্দ্রীয় শক্তি রয়েছে। পৃথিবীর বুকে এখন ধনতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ বিরাজমান। ধনতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে পৃথিবীর সর্বত্র এই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পদলেহীরা মাকড়সার জালের ন্যায় জড়িয়ে আছে।
বাংলাদেশের প্রথম দিকের অসহযোগ আন্দোলন এবং আলোচনা বৈঠকের সুযোগ নিয়ে গণতন্ত্র হত্যাকারী—নরখাদক ইয়াহিয়া বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানী করে আক্রমণের ব্যবস্থা সুদৃঢ় করে আলোচনা বৈঠকের ইতি ঘোষণা করে। তারপর শুরু হল নিরীহ দেশবাসীর উপর পশুসুলভ আক্রমণ; যে আক্রমণে দশলক্ষাধিক নরনারী নির্মমভাবে নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের পথে ঘাটে অসংখ্য নরনারীর ছিন্ন বিচ্ছিন্ন দেহাবশেষ এখনো ছড়িয়ে আছে। এই আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য বাংলার জনসাধারণ প্রথমদিকে প্রস্তুত ছিল না কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই তারা প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলল। ইতিহাস শিক্ষা দেয়, আক্রমণ যত জোরালো হয় তার প্রতিরোধ আক্রমণও তত শক্তিশালী হয়ে থাকে। বলপ্রয়োগের দ্বারা ক্ষণিকের সফলতা সূচিত হলেও সুদূর প্রসারী কোনরূপ বৃহত্তর সফলতা তার মাধ্যমে আসতে পারে না। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা আজ আর ওরা মনে করতে পারছে না, তা যদি পারতো তা’হলে বাংলা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রতি এরূপ চরম বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারতো না। একদিকে জল্লাদ ইয়াহিয়াকে অস্ত্র সাহায্য করে বাংলার সাধারণ দেশবাসীদের খুন করাচ্ছে অপরদিকে সহানুভূতির কথা বলছে। কোরিয়া ও ভিয়েতনামে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ কুকুরের ন্যায় মার খেয়েও যথার্থ শিক্ষালাভ করতে পারেনি। এই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের উপর একান্ত নির্ভরশীল পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর শোচনীয় পরিণতি যে কি হতে পারে তা কল্পনাতীত। বাংলাদেশের অসম সাহসী বীর গেরিলা বাহিনী আজ প্রতিটি রণক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে চূড়ান্ত জয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ আর শুধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর আশা আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসে নূতন সূর্যোদয়ের সূচনা করেছে। এই নবারুণের পূর্ণোদয়ের মধ্যে কোটি কোটি মানুষের মুক্তির ইঙ্গিত নিহিত রয়েছে। বিংশ শতাব্দীর যুগান্তকারী ঘটনার মধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্যতম। নতুন সার্বভৌম স্বাধীন দেশের সৃষ্টি সর্বকালে বিশেষ তাৎপর্য বহন করে আনে। বাংলাদেশের আবির্ভাবও আমাদের কাছে এমনি এক নূতন আশার বাণী বহন করে এনেছে। বাংলাদেশের সৃষ্টি এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা একদিনে আসেনি—১৯৭১ সালে এর আত্মপ্রকাশ হলেও সূচনা হলেছিল অনেক পূর্বে। পৃথিবীর কোন দেশেই ধর্মীয় ভিত্তিতে সৃষ্ট কোন রাষ্ট্র যথার্থ অস্তিত্ব নিয়ে বেশিদিন বাঁচতে পারে না। ভারত ত্যাগ করার সময় বৃটিশ শেষ আঘাত হেনে গেছে দ্বিধাবিভক্ত ভারতে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে। এই সাম্প্রদায়িকতার ব্যক্তি ক্রমান্বয়ে এই উপমহাদেশকে অনেকাংশে রোগগ্রস্ত করতে সমর্থ হয়েছে। (ক্রমশঃ)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!