You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১০ অক্টোবর ১৯৭১

অবরোধ

মুক্তিযুদ্ধের জনপ্রস্তুতি যেমন বিশাল হওয়া দরকার, তেমনি দরকার সেই জনগণকে বিপ্লবের মূল তথ্যটা বোঝানো। সব দেশের মুক্তিযুদ্ধ একইভাবে পরিচালিত হয় না। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে মুক্তিযুদ্ধের চেহারা পাল্টায়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও তার নিজস্ব কায়দায় চলেছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পূর্ণ ভিন্নধরণের। এটার গোড়াপত্তন হয়েছিল গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে যাঁরা নির্বাচনে জয়ী হলেন, তাঁদের সরকার তৈরীর সুযোগ দেওয়া হলো না। উপরন্তু, সামরিক শাসনকর্তারা সৈন্য দিয়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে দমাতে গেলেন। ফলে রাতারাতি গণতান্ত্রিক বিপ্লব পরিবর্তিত হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধে। কাজেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
যখন গণতান্ত্রিক বিপ্লব রূপান্তরিত হয়ে গেল সশস্ত্র বিপ্লবে, তখন প্রথম প্রয়োজন ছিল আত্মরক্ষা করার। কারণ, মুক্তিবাহিনী গড়ে তুলবার জন্য লোক, অস্ত্র, রসদ, আশ্রয় ইত্যাদি প্রয়োজন। এখন মুক্তিবাহিনী এক সুসংগঠিত বাহিনী হয়ে উঠেছে। তাই এবার চলেছে প্রত্যাঘাতের পালা।
এই প্রত্যাঘাত করবার দুটি পথ আছে। প্রথমতঃ সরাসরি যুদ্ধ ও অন্তর্ঘাত, দ্বিতীয়তঃ অবরোধ ও অসহযোগ। যুদ্ধ, অন্তর্ঘাত ও অসহযোগ সম্বন্ধে প্রায় সবারই কিছু ধারণা আছে। কিন্তু অবরোধই হবে বাংলাদেশের বিপ্লবের প্রধানতম অস্ত্র, এবং অবরোধের পর্ব ও বিভিন্ন কৌশল সবাইকে জানতে হবে। শেখ মুজিব একবার বলেছিলেন, আমরা ওদের ভাতে মারবো, আমরা ওদের পানিতে মারবো। সম্ভবতঃ কেউ ধারণাই করতে পারেনি যে কয়েকমাস পরেই এই কথাটি এক চরম সত্য হয়ে দাঁড়াবে।
সাধারণ যুদ্ধে যে অবরোধসৃষ্টি করা হয় তার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের অবরোধ সৃষ্টির এক মূলগত অভ্যাস আছে। তা হলো সাধারণ যুদ্ধে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবরোধ সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ যেহেতু দখলকারী সৈন্যের বিরুদ্ধে চালানো হয়, সেহেতু মুক্তিযোদ্ধারা সমগ্র দেশ জুড়ে অবরোধ সৃষ্টি করে। এ অবরোধের মূল লক্ষ্য হলো শত্রুকে রসদ জোগাড়ের পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া।
এই অবরোধ শত্রুকে শুধু ঘিরে রাখাই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হয় রাস্তা ওড়ানোর, ব্রীজ ভাঙ্গার, বন্দর আক্রমণ করার, এবং সর্বোপরি বিমান চলাচল ব্যাহত করার। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে এইসব পদ্ধতি সফলভাবে অনুসৃত হচ্ছে।
তাছাড়া অবরোধের সাথে অসহযোগ চালানো দরকার। বাংলাদেশের ধান, পাট, ইত্যাদি কৃষিজ দ্রব্য যার ওপর পশ্চিম পাকিস্থানে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে উঠেছে—সেগুলো যাতে পাক হানাদারদের হাতে কিছুতেই না পড়ে তার জন্য সতর্ক থাকা দরকার। চাষী ভাইদের চেষ্টা করতে হবে যাতে তাঁরা ধান, পাট ইত্যাদি কৃষিজ দ্রব্য মুক্তাঞ্চলে মুক্তিফৌজের কাছে পৌঁছে দিতে পারেন। একাজে তাঁরা মুক্তিফৌজের সহায়তা পাবেন।
একই সঙ্গে অসহযোগ ও অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চালাতে পারলে অবরোধ সম্পূর্ণতর হবে। তখন দখলকারী সৈন্যরা বাইরের থেকেও কোনো সাহায্য পাবে না, ভেতর থেকেও কিছু সংগ্রহ করতে পারবে না।
অন্তর্ঘাতমূল কার্যকলাপ, যথা ট্রেন ওড়ানো, রাস্তা ভাঙা, ব্রীজ ওড়ানো—ইত্যাদি করতে গেলে প্রথমে প্রয়োজন বিভিন্ন ধরণের বিস্ফোরক ও তাদের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা। পরে সে সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধের অবরোধের প্রকৃতি বিচার করলে দেখা যায় যে তা অত্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী। এবং অবরোধ যতই বেশী দীর্ঘস্থায়ী হবে। পৃথিবীতে এমন দেশও আছে, যারা বিগত বিশ বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধ চালাচ্ছে। প্রয়োজন হলে বাংলাদেশেও সেরকম করা হবে। এ এক সুদীর্ঘ সুকঠিন সংগ্রাম। এ সংগ্রামে আমাদের জিততেই হবে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!