বিপ্লবী বাংলাদেশ
১০ অক্টোবর ১৯৭১
মুক্তি যোদ্ধাদের জীবনলিপি
—মাহতাব (মামু)
(কুমিল্লা থেকে)
জীবনের স্মৃতির দর্পণে আজো মুকুলের নাম ভেসে ওঠে। মুকুলকে ভুলতে পারিনি। মুকুল বলেছিল “এগিয়ে যেতে”; এগিয়ে চলেছি আমি—উল্কার মত ছুটে চলছি। আমার হাতের মারণাস্ত্র শত্রু সৈন্য নিধন করে চলেছে, কিন্তু তবু মনে একটুকু স্বস্তি পাচ্ছি না কেন? কেন বার বার মনে পড়ে যায় বিগত ২৮শে মার্চের রাতের কথা? ২৮শে মার্চ আমার জীবনে, তথা বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। অমর হয়ে আছে মুকুলের মা, মানে আমাদের সবার মাসীমা, সেদিন মুকুলকে আমাদের তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “আমার ছেলেকে দেশের স্বার্থে তোমাদের হাতে অর্পণ করলাম, ওকে তোমরা দেখো”।
২৮শে মার্চ! আবার স্মৃতির সাগরে ঝড় উঠল। উত্তাল তরঙ্গায়িত ঢেউয়ের মাঝে মনটা ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল। এ সময় ভাসতে ভাসতে এসে ঠেকল বিগত ২৮শে মার্চের তীরে।
গভীর রাত। আমরা শতাধিক বাঙালী যোদ্ধা এগিয়ে চলেছি। পূর্ণিমার পূর্ণ চাঁদটা মাথার উপর আমাদের পথ দেখিয়ে দিচ্ছে। আজ রাতের মধ্যেই আখাউড়া পাক সামরিক ছাউনি আমাদেরকে আক্রমণ করতে হবে। সংবাদ এসেছে আখাউড়ায় পাক হানাদাররা ছাউনি ফেলেছে।
রাত দু’টোর সময় আমরা ছাউনির কাছাকাছি এসে পড়লাম। দূর থেকে ছাউনির লাল আলোটা যেন কিসের ইঙ্গিত করছে। সবাই প্রস্তুত হয়ে নিলাম। কমান্ডারের নির্দেশমত রেল লাইনের পাশে পজিশান নিয়ে নিলাম। এরপর রাতের নির্জ্জনতাকে খান খান করে আমাদের হাতের অস্ত্র গর্জন করে উঠল। প্রতিবাদ এল ছাউনি থেকে। শুরু হল একধারে স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ আর একধারে স্বাধীনতা হরণের ঘৃণ্য পৈশাচিকতা। হঠাৎ একটা আর্ত-চিৎকারে আমার হাতের অস্ত্র থেমে গেল। শব্দ লক্ষ্য করে পেছনে তাকালাম। দেখলাম নীচে কে যেন পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তাড়াতাড়ি নেমে গেলাম নীচে। কাছে যেতেই সমস্ত শরীরটা আমার পাথরের মত স্তব্ধ হয়ে গেল। মুকুল বুকে গুলীবিদ্ধ হয়েছে।
ধীরে ধীরে এক-সময় মাথার উপরের চাঁদটা হারিয়ে গেল। সামনের অন্ধকার পৃথিবীটা আরো আরো অন্ধকারের অতলান্তে তলিয়ে গেল। আর নিজেকে মনে হল, যেন হারিয়ে যাচ্ছি একটা বিরাট গহ্বরের মধ্যে।
অন্ধকারের বুক চিরে ক্ষীণ একটা কন্ঠস্বর ভেসে এল, “মামু দাঁড়িয়ে থেকোনা। যাও—এগিয়ে যাও—ওদের শেষ করো। ওরা আমাদের স্বাধীনতা হরণ করতে চায়—ওদের ধ্বংস করো”। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে শুরু করেছিল, “আমার জন্য ভেবোনা; আমার সময় হয়ে এসেছে। মা আমাকে উৎসর্গ করেছিল জননী জন্মভূমিকে, সেই জীবন মাতৃভূমির নামে বলি দিতে পেরে আজ আমি ধন্য। তুমি আর বসে থেকোনা মামু, যাও এগিয়ে যাও যারা আমাদের সোনার বাংলাকে শ্মশান করেছে, যারা মা বোনের ইজ্জত ছিনিয়ে নিয়েছে, সেই রক্ত লোলুপ পশুগুলোকে এদেশ থেকে নির্ম্মুল করো”—বলতে বলতে ক্ষীণ কন্ঠস্বরটা আরো ক্ষীণ হয়ে এসেছে কিন্তু তখনও বলে চলছে মুকুল, “দস্যু হানাদারদের নখরাঘাত থেকে আমার পুণ্য ধরিত্রীকে রক্ষা করো—রক্ষা করো—রক্ষা করো”—ক্ষীণ কন্ঠস্বরটা স্তব্ধ হয়ে গেল। তেরো বছরের একটি কিশোর বাংলার স্বাধীনতার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করে গেল। পথ দেখিয়ে গেল আগামী দিনের সংগ্রামীদেরকে।
পূবের আকাশে রং ধরেছে। গোলাগুলী থেমে গেছে। পাক দখলদাররা ছাউনি ছেড়ে পালিয়েছে। ছাউনি এখন আমাদের দখলে। সবাই এ আনন্দে গান ধরেছে, “জয় বাংলা—বাংলার জয়”। কিন্তু আনন্দ নেই আমার মনে। ব্যথায় বিমূঢ় হয়ে আছে আমার মনটা। মুকুল চলে গেছে অমৃতলোকে। মুক্তি যুদ্ধের ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছে মুকুল।
বুক ফেটে কান্না আসতে চাইছে। কিন্তু কাঁদতে নেই সংগ্রামীকে। তাছাড়া মুকুলের যাত্রাপথকে কেঁদে পিছল করে দিতে চাইনা আমি। ও চলে গেছে, ও চলে যাক্। ওর মৃত্যুর মধ্য দিয়েই জন্ম নেবে লাখো লাখো মুকুল, মুকুল হয়ে ফুটে থাকবে চিরদিন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে। ভোরের প্রথম আলোয় মুকুলকে সেদিন মনে হয়েছিল একটি নিষ্পাপ ফুটন্ত ফুল বলে। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে ছিল আমার কোলের উপর মাথা রেখে! এ দৃশ্য আজো মনে পড়লে আমার হাতের আগ্নেয়াস্ত্র থেমে যায়। তাইতো কিছুতেই ভুলতে পারিনা মুকুলকে। আসলে মুকুল তেরো বছরের একটি জীবন নয় শুধু। ও ছিল সংগ্রামী আদর্শের প্রতীক। সেই আদর্শের পথ ধরেইতো আজ আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল