You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১০ অক্টোবর ১৯৭১

বাংলার পথে প্রান্তরে
—দিলীপ কুমার দাস

“বাংলার রূপ দেখিয়াছি আমি,.
পৃথিবীর রূপ দেখিতে চাহিনা।”
কবি কন্ঠের এই বাণী কতটা সত্য তার বিচার বিবেচনা ঘরে বসে করা যায়না এর যথার্থ সত্যটি ধরা পড়বে বাংলার দিগন্ত প্রসারিত মাঠ, নীল আকাশ, নদী মেঘলা আর গ্রাম বাংলার শত সহস্র পল্লী গ্রামের মাঝে ঘোরাতো রয়েছে জাগ্রত বাংলার জীবন প্রবাহ। কবিদের—‘সোনার বাংলা’, ‘রূপসী বাংলা’, এবং ‘বাংলা দেশ আজ রূপান্তরিত হয়েছে বিপ্লবী বাংলা দেশে, কেন আজ সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা সোনার বাংলার শান্তিকামী মানুষের দল বিদ্রোহী? কেন আজ কোটি কোটি মুক্তিকামী মানুষ আশ্বিনের ঝড়ের ন্যায় রুদ্র মূর্তিতে ফেটে পড়েছে বাংলার মুক্তি যুদ্ধে? কেন আজ শত সহস্র তরুণ মুক্তি যোদ্ধারা উল্কার মত বাংলার শহরে, গ্রামে, নগরে, বন্দরে, পথে, প্রান্তরে পাক পশু হানাদার নিধনের মহান ব্রত নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৃত্যুর সাথে কঠিন হস্তে পাঞ্জা ধরে? এ সব প্রশ্নের জবাব শোষিত নিষ্পেষিত কোটি কোটি মানুষের দুর্বিসহ জীবনের সাথে মিশে আছে। তাই আজ জীবন মূল্য দিয়েও স্বাধীন বাংলা অর্জনের জন্য মুক্তি যোদ্ধারা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। বাংলার এই বিপ্লবী-রূপই আজ সর্বত্র বিরাজমান।
আমরা কজন চলছি গ্রাম বাংলার আঁকা বাঁকা মেঠো পথ পেরিয়ে মুক্তি যোদ্ধাদের আঞ্চলিক কার্য্যালয়ের দিকে। দীর্ঘ সময় পথ পরিক্রমার পর বরিশালের উত্তরে দুয়ারিকায় এসে উপস্থিত হলাম। দূরের কয়েকটি আলোর ক্ষীণ শিখার প্রতি অঙ্গুলি নির্দেশ করে ফরিদ ও মিন্টু আমাদের গন্তব্য স্থানের অবস্থান জানাল। ছোট একটি নদী গ্রামটির গা ঘেসে বয়ে গেছে—মনে হয় মা যেন সন্তানকে দুহাতে পরম যত্নে জড়িয়ে রেখেছে। কয়েকদিন পূর্বে এখানে পাক হানাদারদের সাথে মুক্তি যুদ্ধাদের এক সার মুখী সংগ্রাম হয়ে গেছে। একজন ব্রিগেডিয়ারের নেতৃত্বে দু-সহস্রাধিক হানাদার কুত্তা মুক্তাঞ্চলটি আক্রমণ করেছিল। পথ চলতে চলতে মুক্তি বাহিনীর অতন্দ্র প্রহরীদের সাথে মাঝে মাঝে দেখা হচ্ছে; ওদের কাছ থেকে সঠিক পথের নির্দেশ সংগ্রহ করে আমরা এগিয়ে চলেছি। প্রতিটি সৈনিকের লৌহদৃঢ় মনোবল এবং কঠিন সঙ্কল্প আমাদের অভিভূত করে দেয়। বাংলার যে সব লোক এখানে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ না করে দূরে সরে আছে তারা জীবনের চির আকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতা থেকে বঞ্চিত হয়ে রইল। বিরাট অঞ্চল—অনেকগুলো ছোট ছোট গ্রাম নিয়ে এই বিরাট মুক্তাঞ্চলটি। রাত দশটা হবে, প্রধান কার্য্যালয়ে এসে উপস্থিত হলাম। তাবুর কাছাকাছি যেতেই ডাঃ হুদাও গেরিলা বাহিনীর সৈনিক মিঃ মিত্রের সাথে দেখা হল। মুক্তি বাহিনীর কয়েকজন সৈনিক এখানকার যুদ্ধে সামান্য আহত হয়েছেন—ওরা ডাঃ হুদার তত্ত্বাবধানে তাবুতে আছেন। এই নির্ভীক বীরদের দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না, ডাঃ হুদার অনুমতি নিয়ে তাবুর মধ্যে প্রবেশ করলাম। দেখলাম দশ বারো জন আহত ভাইয়েরা শুয়ে আছেন। জিজ্ঞাস করলাম কেমন আছেন? বীর সেনানির ন্যায় সৈনিক রহমান উত্তর দিলেন ‘শুয়ে থাকতে আর ভাল লাগেনা—সামান্য আঘাত পেয়েছি অথচ ডাঃ হুদা কিছুতেই ‘অপারেশনে যেতে দেবেন না।’ প্রায় সব কটি তরুণের সাথে আলাপ করে একই জবাব পেলাম। এই নির্ভীক সৈনিকদের সাথে আলাপ করে এক নূতন প্রেরণা আমাকে উদ্বেলিত করে তোলে—ইচ্ছে হয় কাঁধে রাইফেল নিয়ে ওদের ন্যায় বাংলার মুক্তি যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। বাংলার যে সব শক্ত সমর্থ তরুণের দল এখনো মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেনি অথচ বসে বসে শুধু চায়ের পেয়ালায় তুফান তুলছে। তারা জীবনের কি সুবর্ণ সুযোগ হেলায় হারাচ্ছে তা একবার ভেবে দেখা উচিত। আগামী দিনের বংশধরেরা যখন জানবে স্বাধীন বাংলার মুক্তি যুদ্ধে তাদের কোন অবদান নেই তখন ঘৃণায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবে। তাবু থেকে বেরিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীর ক্যাপ্টেন মিঃ রহমানের সাথে দেখা করতে গেলাম। একটা বড় গাছের নীচে বসে মৃদু আলোতে কয়েকজন সহযোদ্ধার সাথে জরুরী আলোচনায় ব্যস্ত আছেন। ‘বিপ্লবী বাংলাদেশের’ সংবাদ সংগ্রহের জন্য আমরা এসেছি জেনে ‘জয় বাংলা’ বলে স্বাগত জানালেন। ক্যাপ্টেন রহমান আর সাধারণ সৈনিকদের মধ্যে পার্থক্যই দেখতে পেলাম না; সহযোদ্ধাদের সাথে তুলতুলে সবুজ ঘাসের বিছানায় বসে বন্ধুর ন্যায় আলোচনা করছেন অথচ চোখে মুখে রয়েছে দৃঢ় কর্তব্যপরায়ণতায় ছাপ কিন্তু নেই কোন পদমর্যাদার দাম্ভিকতা। হানাদারদের প্রতিহত করার ঘটনা তিনি সাধারণ ঘটনার মত বলে চললেন। হানাদারদের আক্রমণ থেকে মুক্তাঞ্চলটি রক্ষা করার জন্য মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের অনেকগুলো উপদলে বিভক্ত করে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি হবার নির্দেশ দিয়ে রহমান সাহেব সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন। এক সময় নির্দেশ আসে শুরু হয়ে যায় আক্রমণ। ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি ছুটতে লাগল। এক নাগাদ আট ঘন্টা গুলি বিনিময়ের পর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনব গেরিলা পদ্ধতির আক্রমণের মুখে দাঁড়াতে না পেরে খান সেনারা পালিয়ে যায়। গেরিলাদের হাতে অসংখ্য খান সেনা নিহত; ব্রিগেডিয়ারের কোন খোঁজ নেই—বোধহয় বাংলার কাদামাটিতে চিরদিনের জন্য খাবি খাচ্ছে। বাংলার মাটি আজ মুক্তি বাহিনীর দুর্জয় ঘাঁটি এ সত্যটি সব হানাদার বাহিনী বুঝতে পেরেছে। ভীত সন্ত্রস্ত নরপশুর দল আজ আর ‘ব্যারাক’ ছেড়ে বাইরে বের হতে সাহস পাচ্ছেনা। মুক্তি বাহিনী এ যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করতে সমর্থ হয়েছে। মুক্তি বাহিনীর প্রতিটি সৈনিক এক একটি দুর্জয় দুর্গ। জীবনের সব কিছু ত্যাগের বিনিময়েও তাঁরা পেতে চায় বাংলার স্বাধীনতা। বাংলার সর্বহারা মানুষেরাও পৃথিবীর বিবেক সম্পন্ন রাষ্ট্রগুলির কাছে আবেদন করছে অস্ত্র সাহায্যের জন্য! কথা প্রসঙ্গে রাজনৈতিক সমাধানের প্রসঙ্গ এসে যায়—মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তাচ্ছিলের হাসি হেসে বলে উঠলেন—কার সাথে রাজনৈতিক সমাধান? নরপশু জল্লাদ ইয়াহিয়ার সাথে? পঁচিশে মার্চের পর সে প্রশ্নতো আর আসতে পারে না। বাংলাদেশ, পাকিস্তান আজ মৃত আর তার কবরের উপর জন্ম নিয়েছে সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ যা প্রতিটি বাঙালীর নিকট চোখের মনির ন্যায় প্রিয়। দশ লক্ষ নিরীহ বাঙালীর রক্তে বাংলার পথ ঘাট রঞ্জিত আর এক কোটি দেশবাশী আজ ঘর ছাড়া—শহীদদের রক্তে ভেজা পথ মারিয়ে শ্মশানের বুকে কোনরূপ রাজনৈতিক সমাধান আজ আর হতে পারে না। ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বঙ্গবন্ধুর এই উদাত্ত কন্ঠের আহ্বান প্রতিটি বাঙালীকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেছে। নিশ্চিত জয়ের পথে মুক্তি যোদ্ধারা যখন এগিয়ে চলেছেন তখন কোনরূপ বিভ্রান্তিকর রাজনৈতিক বা অন্য কোন আপোসমূলক সমাধানের পথে বাংলার জাগ্রত জনতারা যেতে পারে না। ইয়াহিয়ার কারাগার ভেঙ্গে স্বাধীন বাংলার সৈনিকরা বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনবে আপোসের মাধ্যমে নয়!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!