You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১০ অক্টোবর ১৯৭১

বঙ্গ আমার, জননী আমার
মোহাম্মদ আব্দুল হাফিজ

মুক্তিবাহিনীর শিবিরে শিবিরে ঘুরছি। ছেলেদের সঙ্গে কথা বলছি। ওদের জানতে ও বুঝতে চেষ্টা করছি। ওদের কাছ থেকে শেখার চেষ্টা করছি। এতকাল ওদের বয়সী ছেলেদের আমি পড়িয়েছি। আর আজ আমি ওদেরই ছাত্র হয়েছি।
মনে ভেবেছি যুদ্ধ আর যুদ্ধাস্ত্রের আমি কিই বা ‍বুঝি! ওসব ওদের কাছ থেকেই শিখতে হবে। বিনীত বাধ্য ছাত্রের মতই শিবিরে শিবিরে গেছি শেখার উদ্দেশ্যে—শেখাবার উদ্দেশ্যে নয়। ওরা কি ভাবছে, ওদের মনে কোন্ কোন্ প্রশ্ন দানা বেঁধেছে, ওদের ভাবনা চিন্তার বিষয়বস্তুটা আমার জানা চাই। তাই শিবিরে শিবিরে জানতে চেয়েছি ওরা কেউ কবিতা লিখছে কিনা, গান গাইছে কিনা, গল্প-প্রবন্ধ-নাটক লিখেছে কিনা। প্রতিটি শিবিরে পরিচালকরা আমাকে সাহায্য করেছেন। এঁদের সহযোগিতা না পেলে আমি কিছুই করতে পারতাম না। তাই এঁদেরকে আমার ধন্যবাদ জানাই।
বাংলাদেশের তরুণ সন্তানরা দেশকে মুহূর্তের জন্যও ভোলেনি। গানে কবিতায় প্রবন্ধে বাংলাদেশকে ওরা মূর্ত করে তুলেছে। এমন কোন শিবির নেই যেখানে কবি নেই, গায়ক নেই, অভিনয় করবার লোক নেই। ভাবি, যে হাত রাইফেল ধরছে সেই হাতেই কলম চলছে। অসি ও মসীর পার্থক্য ওরা ঘুচিয়ে দিয়েছে। আথচ আমার মত সুযোগসুন্ধানী বুদ্ধিজীবীরা আজ অবধি আগের সুখের দিনগুলোর কথা ভেবে জাবর কাটছেন!
আমার দেশ, তোমার দেশ, বাঙলাদেশ—বাঙলাদেশ। ঘুরতে ঘুরতে এক শিবিরে দেখা হল কবি নওয়াব আলির সঙ্গে। বাংলাদেশ তাঁর কবিতায় রূপ নিয়েছে এভাবে :

বঙ্গ আমার জননী আমার
আমার জন্মভূমি
স্বর্গ হতে গরীয়সী মা
প্রাণ হতে প্রিয় তুমি।

এই কবিরই লেখা :-

বাংলাদেশ, বাংলাদেশ
সবার ঊর্দ্ধে বাংলাদেশ
জানুক মানুষ সর্বলোকের দেশ-বিদেশ,
সব কথারই সর্বশেষ
মোদের সোনার বাংলাদেশ বাংলাদেশ।

বাংলাদেশই যেন কবির ধ্যান, জ্ঞান, জীবন। সব কথারই সর্বশেষ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ। বাঙলাদেশের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষার কথা। কবি এম.ডি. শাহাদাত হোসেন লিখেছেন :

বাংলা মোদের জন্মভূমি
বাংলা মুখের ভাষা,
বাংলার বুকে লুকিয়ে আছে
কত নবীন আশা।

শাহাদাত হোসেন এরপর একে একে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সমস্ত প্রসঙ্গ বয়ান করেছেন। স্মরণ করেছেন রফিক, সালাম, বরকতকে। শিবিরে শিবিরে যত গান বা কবিতা শুনেছি তাতে বাংলাদেশ ও বাংলাভাষার প্রস্ঙ্গ এসেছে পরস্পরের হাত ধরাধরি করে। শাহাদাতের সঙ্গে একমত বাঙালী জাতি। মা এবং মাতৃভাষার তফাৎ কিছু নেই।
শিবিরে শিবিরে মুজিব যেন এক জীবন্ত প্রেরণা। গানে কবিতায় তিনি যেন এক মহান নায়ক। মুজিব ছাড়া বিশ্বে হয়তো অন্যকিছু থাকবে—কিন্তু বাঙালী, বাঙালীয়ানা, বাংলাভাষা—এসব বুঝি থাকবে না। একটা মানুষের প্রতি মুক্তিবাহিনীর এমন আনুগত্য আমার কাছেও বিস্ময়কর ঠেকেছিল। মুক্তিবাহিনীর অন্তরটাকে আমি বাইরে আনতে গিয়ে দেখি তাদের অন্তর জুড়ে বসে আছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এম.এ. আকবর হোসেন্ একটি অপূর্ব ভাটিয়ালী শুনিয়েছেন। তাঁর নিজেরই লেখা :-

মুজিব বাইয়া যাওরে
জনগণের নাও
ওরে মুজিব বাইয়া যাওরে।
ছয় দফারই নৌকাখানা
এগারোদফা হইয়া
বঙ্গবন্ধু হাল ধরেছে
বাদাম দাও তুলিয়া-রে ।।
সাতকোটি সে নৌকার যাত্রী
সাড়ে চারশত নাইয়া
তোপ-কামানের ভয় কোরো না
নৌকা যাও বাইয়া রে।
পথে যত লাল কুত্তা আছে
মারবো বৈঠা দিয়া,
তোপ-কামানের ভয় কোরো না
নৌকা যাও বাইয়া রে।
আমরা যত যাত্রী আছি
যাব আগাইয়া রে,
দিচ্ছি রক্ত, দিব আরো
বাংলা মার লাগিয়া রে।
মহান দেশের মহান নেতা
তোমাকে পাইয়া রে
অধীন আকবর যাত্রী হল
ছয়দফার গান গাইয়া রে।।

না এরকম একটি নয়, অসংখ্য গানে শেখ বন্দিত হয়েছেন। তাঁর প্রণীত ৬ দফা ও ছাত্রদের ১১ দফার কথা মুক্তিবাহিনী ভোলেনি।….(ক্রমশঃ)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!