You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা
মৌলানা নাজুক খান

পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সম্প্রতি বাংলাদেশ সমস্যা, অর্থাৎ পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা সম্পর্কে সামান্য বিব্রত হয়ে রয়েছেন। তার ‍ওপর আবার ভারত কিনা সেই ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যায় হস্তক্ষেপ করছে। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘে অভিযোগ জানানোর জন্য পাক সরকার বিশেষ প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন। এই ‘আভ্যন্তরীণ’ শব্দটি আমাদের বিপুল হাস্যোদ্রেক করেছে।
‘আভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে ইয়াহিয়া বাংলাদেশের সমস্যাকে বিশ্বের কাছ থেকে আড়াল করে রাখতে চাইছিলেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি বলেই তাঁর ভারতের ওপর এত রাগ। আচ্ছা ইয়াহিয়া সাহেব, কোনো সমস্যাকে ‘আভ্যন্তরীণ’ কখন বলা হয়, তা আপনি নিশ্চয়ই জানেন। তা হলো যখন দেশের অভ্যন্তরে কোন সমস্যা দেখা দেয়, এবং সে দেশের সরকার নিজেই সে সমস্যার মোকাবিলা করেন।
এক্ষেত্রে ইয়াহিয়া সাহেবের বক্তব্য হলো, বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে, এবং পাকিস্তান সরকার নিজেই বাংলাদেশ সমস্যার মোকাবিলায় সক্ষম। কাজেই, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা। অথচ পশ্য, নির্লজ্জ ভারত কিনা সে ব্যাপারে নাক গলিয়ে বসে আছে। অতএব বিশ্ববাসী, ভারতকে নিজের চরকায় তেল দিতে বল এবং পাকিস্তানকেই তার আভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করতে দাও।
বক্তব্যের ভাষাটা খুবই পরিষ্কার, কেবল তার মানেটাই ধোঁয়াটে। যেমন ধরা যাক ‘বাংলাদেশ পাকিস্তানের অভ্যন্তরে’—এই কথাটা। কি হিসেবে বাংলাদেশ পাকিস্তানের ‘অভ্যন্তরে’? ভোগৌলিক অর্থে? নিশ্চয়ই নয়। শুধু তাই বা কেন, রাজনৈতিক অর্থেও নয়; কারণ তার সম্পূর্ণ ক্ষমতা, সম্পদ, জনবল ও মনোবল রয়েছে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হওয়ার মতো। যে আমেরিকা বিশ্ব-সাম্রাজ্যবাদের প্রবক্তা, সেও ভিয়েটনামকে নিজের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলেনি। অথচ দেড় হাজার মাইল পারের একটি ভূখন্ডের স্বাধীনতার সংগ্রামকে ইয়াহিয়া পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলে চালাতে চান। এবং তাও গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের, তথা বাংলাদেশর জনগণের, মতামতকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে।
অতএব, ইয়াহিয়া সাহেব ‘আভ্যন্তরীণ’ শব্দটা নিশ্চয়ই পাকিস্তানের অভ্যন্তর বোঝাতে ব্যবহার করেননি। তাও এটাকে আমরা পাকিস্তানের ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা বলে কিছুটা মানতে পারতাম, যদি পাক সরকার নিজেই এই সমস্যার সমাধানে সক্ষম হতেন। কিন্তু ইয়াহিয়া সাহেব তো নিজেই বিদেশী বিশেষজ্ঞদের ডেকে এসেছেন সংকট সমাধানের জন্য, বিদেশ থেকে অস্ত্রসম্ভারও এনেছেন। তবুও দমানো যায়না বাঙালীকে। হয়তো ইয়াহিয়া সাহেব জোর করে ভুলবার চেষ্টা করছেন যে, শোষিত-নিপীড়িত মানুষ যখন তার অধিকার অর্জনে ব্রতী হয়, তখন সে মরণপণ সংগ্রাম করে। ভাড়াটে মাইনেকরা সৈন্যদল সে সংগ্রামে পিছু হটতে বাধ্য।
বাংলাদেশ সমস্যাকে ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা বলে ইয়াহিয়া তাঁর কলঙ্কের কথা বিশ্বের কাছ থেকে লুকোতে চাইছেন। কিন্তু যুক্তিহীন উক্তিতে তো বিশ্ব ভোলেনা, তাই তিনি ভারতের হস্তক্ষেপের কথাও এর সাথে জুড়ে দিয়েছেন। ইয়াহিয়ার অনন্যসাধারণ মিথ্যাচারের এ এক অন্যতম নিদর্শন। একটা জাতির স্বাধীনতা আন্দোলনকে তিনি অন্যদেশের প্ররোচনা বলে চালাতে চান।
ভারত যে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ তার আর প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না। তার দোষ কেবলমাত্র কোটি খানেক শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়া। ভারত নিজেই শত সহস্র অভাব-অনটনে রয়েছে। তার মধ্যেও এতো শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে যে কতোখানি মানবতাবাদ এবং বুকের পাটা লাগে, তা ইয়াহিয়া সাহেবের অজানা। তিনি শুধু জানেন যে, শরণার্থীরা ভারতে যাওয়ার ফলে তাঁর কুকীর্তির কথা ফাঁস হয়ে গেছে : অতএব দাও ভারতকে কিঞ্চিৎ দাওয়াই।
কিন্তু যুক্তির দিকটা ইয়াহিয়া সাহেব আবার এড়িয়ে গেলেন। বিশ্ব-রাজনীতি অনুসারে ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা ‘আভ্যন্তরীণ’ থাকে ততোক্ষণই, যতোক্ষণ তাতে বিদেশী হস্তক্ষেপ না ঘটে। ইয়াহিয়া সাহেব গোড়াতেই বিদেশী বিশেষজ্ঞ সাহায্য অস্ত্রসম্ভার আনিয়ে ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যাকে আন্তর্জাতিক করে তুলেছেন। তবু তিনি এটা ‘আভ্যন্তরীণ’ সমস্যা বলে চালাতে চান। ঠিক আছে, না হয় আমরা তা মেনে নিলাম। কিন্তু ভারতের হস্তক্ষেপ সম্বন্ধে ইয়াহিয়া যা বলেছেন তা যদি সত্য হতো, তবে কিছুতেই এ সমস্যাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা বলা যেতো না। কারণ, যে মুহূর্তে ভারত এতে হস্তক্ষেপ করতো, সে মুহূর্তে এটা ভারত ও পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রের মধ্যে সংঘর্ষ রূপে পরিগণিত হতো। অর্থাৎ এ সমস্যা মুহূর্তমধ্যে পাকিস্তানের এখতিয়ার থেকে দুনিয়ার দরবারে চলে যেতো।
মোদ্দা কথা, আগা মহম্মদ ইয়াহিয়া খান সাহেব, যতোই আপনি ‘বাংলাদেশের সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ সমস্যা’ বলে বেড়ান না কেন, আপনার অসার যুক্তিজাল বিশ্বের জনগণকে ভোলাতে পারবেনা। তার প্রথম প্রমাণ পাবেন রাষ্ট্রসংঘের সাম্প্রতিক অধিবেশনে—আর শেষ প্রমাণ দেবে বাংলাদেশের জনগণ, তাদের স্বাধীনতা অর্জনের মাধ্যমে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল