You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | বাংলাদেশের সংগ্রামে জয়লাভ করা জরুরী কেন—অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

ওপার বাংলা থেকে :
বাংলাদেশের সংগ্রামে জয়লাভ করা জরুরী কেন—অর্ঘ্যকুসুম দত্তগুপ্ত
সম্পাদক ‘সমতট’ পত্রিকা, পশ্চিমবঙ্গ

(ভারতীয় প্রতিনিধি প্রেরিত)
বাংলাদেশের সংগ্রাম প্রায় এক বছরের মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছে। নানা দেশের নানা লোক একে নানা চোখে দেখছেন। কারও লক্ষ্য পাকিস্তানের শক্তিখর্ব, কেউ বা চান পাকিস্তানের ‘সংহতি’ রক্ষা, কোনো গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সমর্থন। এক কোটি শরণার্থীর দুর্বিষহ বোঝা থেকে বাঁচবার জন্য কেউ বাংলাদেশের জয় চাইছেন, আবার প্রধানতঃ হিন্দুরা চলে আসছেন বলে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি বিরূপ কেউ কেউ। এ এক অদ্ভূত স্বার্থপর, মানবতা বিরোধী বিচার! বলাবাহুল্য, বাঙালীর বিপদ হিসেবেই বহু বাঙালী নিঃস্বার্থভাবে বাংলাদেশের জয় কামনা করছেন। অন্যথায় এতো অল্প সময়ের মধ্যে এতো ব্শেী শরণার্থীর বোঝা মেনে নেওয়া মানসিক ভাবে সম্ভব হতোনা। অবশ্য সাধারণ ভাবে ভারতবাসীর কাছে, এবং বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার অধিবাসীদের কাছে, বাংলাদেশের সবিশেষ কৃতজ্ঞ থাকা উচিত—কারণ, ভারতবর্ষের নৈতিক সমর্থন না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম এতো তাড়াতাড়ি দানা বাঁধতে পারতোনা না, অন্তত বহু বছর পিছিয়ে যেতো।
কিন্তু এসব সামান্য ব্যাপার। বাংলাদেশের লোকদের, তার মুক্তিযোদ্ধাদের, সেলাম জানাই অনেক অনেক গভীর সম্মানবোধ থেকে, কৃতজ্ঞতাবোধ থেকে, গর্ববোধ থেকে।
গর্ববোধ থেকে, কারণ আমিও বাঙালী (এবং বাঙালও বটে) কৃজ্ঞত, কারণ আমরা পশ্চিমবাংলার ভারতীয় নাগরিকেরা যখন গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মহান আদর্শ পেয়েও হারাতে যাচ্ছিলাম তখন আপনারা, বাংলাদেশের লোকেরা, আমাদের নতুন করে আদর্শে বিশ্বাস রাখার অনুপ্রেরণা দিলেন। সম্মানবোধ থেকে, কারণ বহুকিছু হারাতে বসলেও আদর্শকে স্বীকৃতি জানানোর ক্ষমতা না হারানো আত্মসম্মানবোধ রক্ষা করতে পারারই সামিল।
আপনারা, বাংলাদেশের অধিবাসীরা, ইতিহাসকে বেশ কয়েকধাপ এগিয়ে দেবার সংগ্রামে ব্রতী। মরক্কো থেকে মালয়েশিয়া হয়ে ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ধর্ম্মান্ধতার বিরুদ্ধে অন্তরের প্রেরণা থেকে রুখে দাঁড়াবার নজীর ইতিহাসে নেই—ভারতেও নেই। ভারতে ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সংবিধানে যা লেখা আছে বা বিদগ্ধ মহলে যা বলা হয় তা অন্তরের প্রেরণা থেকে আসেনি; এসেছে প্রধানতঃ ঘরের নিশ্চিন্ত আরামে বসে উদার হবার বাসনা থেকে। ব্যতিক্রম আছে, কিন্তু ব্যতিক্রম তো সিদ্ধান্তকে প্রমাণিত করে মাত্র। আমরা যখন চিন্তাবিলাসী, আপনারা তখন আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে জাতীয় ও মানবিক সম্মানবোধের ঐতিহ্য তৈরী করতে সংগ্রামরত।
ইতিহাস তৈরী করেছেন আরো নানা দিক থেকে। রাজনৈতিক বিচারে নয়—রাজনৈতিক বিচারে বহু জাতি তৈরী হয়, বিনষ্ট হয়—আপনারা জাতির মহানতম সংজ্ঞার কষ্টিপাথরে যাচাই হয়ে আত্মচেতনার অগ্নিপরীক্ষার থেকে জন্মালেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ঐতিহ্য থেকে জন্মালেন, একটা জাতির মুক্তিচেতনা সাথে করে জন্মালেন।
পশ্চিমবাংলার বাঙালীরা যখন অবক্ষয়ের গোলকধাঁধায় (নাকি চোরাবালিতে) আবদ্ধ, আমরা যখন নতুনকেও নিতে পারলাম না, ঐতিহ্যকেও ত্যাগ করলাম, যখন এক বিরাট নিরালম্ব অবস্থায় আমরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়—তখন আপনারা আমাদের আশার আলো দেখাচ্ছেন। এ এক বিরাট ঐতিহাসিক কাজ, আঞ্চলিক অর্থে।
সাধারণতঃ একটা জাতি একটা নেতার নির্দেশে এগিয়ে যায়, সংগ্রাম করে; আপনাদের ক্ষেত্রে একটা জাতির নেতা সেই সমগ্র জাতিই। এতোদিন আপনাদের নেতারা ছিলেন অপর এক জাতির বেতনভুক কর্ম্মচারী। এখন সংগ্রামের প্রয়োজনে সংগ্রামে নেতা তৈরী হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ একটা জাতির প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে নেতৃত্বভার গ্রহণ করেছে—জাতির বাঁচবার সংগ্রামে, স্বাধীনতার সংগ্রামে, আর দশটা ছোটবড় জাতীয় দলের সঙ্গে একসঙ্গে লড়ছে। সংগ্রামের সময়ে সবাই বড়ো, যার যার কাজ করে যাওয়াটাই বড়ো। আজকের সংগ্রাম শুধু রণক্ষেত্রে জেতার সংগ্রাম নয়, অনেক বড়ো কিছুর সংগ্রাম, মানবিকতার একটা আদর্শ সৃষ্টির সংগ্রাম—এ সংগ্রাম সারা পৃথিবীময় মুক্তির সংগ্রাম। একটা সম্পূর্ণ জাতি সৃষ্টির সংগ্রাম প্রথম চেষ্টাতেই সম্পূর্ণ হয়না, নিখাদ হয়না; অনেক দুঃখের মধ্য দিয়ে সৃষ্টি সম্পূর্ণ হয়। এসত্য নিশ্চয়ই আপনারা ধীরে ধীরে, কিন্তু মর্মে মর্মে, উপলব্ধি করতে পারছেন। বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই যে অনেক আঘাত, অনেক বিশ্বাসঘাতকতা, অনেক শঠতা, অনেক প্রবঞ্চনা, অনেক হারানোর দুঃখ জয় করে চূড়ান্ত জয়ের সোনার দুর্গ তৈরী হয়! এটা বোধহয় প্রয়োজনও। যে জাতি নানা অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়নি, সে জাতি বিজয়ের পরম লগ্নে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। তাই বলা হয়ে থাকে সদাসচেতনতার মূল্যে স্বাধীনতা ও আদর্শ রক্ষা করতে হয়।
পৃথিবীর লোকদের উপর অভিমান হয়ে লাভ নেই। এটাও বাস্তব অভিজ্ঞতাগুলোরই একটা। মানুষ বৈজ্ঞানিক ক্ষেত্রে অনেক এগিয়ে গেছে, কিন্তু বিশ্বাসের ক্ষেত্রে, সহানুভূতির ক্ষেত্রে, মানুষের মান ধীরগামী। এর কারণও আছে। সারা পৃথিবী জুড়ে এতদিন যে মিথ্যাচার ও স্বার্থপরতার বেসাতি চলেছে, তাতে সাধারণ মানুষের পক্ষে সত্য আবিষ্কার করা সুকঠিন।
আপনাদের সংগ্রাম তো এই মিথ্যারই বিরুদ্ধে—সত্যের স্বপক্ষে। শুধু তাই নয় আপনাদের সংগ্রাম মূক নিপীড়িত পৃথিবীবাসীর ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। তাই আপনাদের বিশ্বাসে অটল, সংগ্রামে দৃঢ়, ভবিষ্যতে বিশ্বাসী, হতেই হবে। নইলে মানুষের অগ্রগতির ইতিহাস আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক—উভয় অর্থেই পিছিয়ে যাবে। তা আপনারা যাঁরা নিজেদের আত্মবিশ্বাসে দাঁড়িয়েছেন—ক্ষুদ্রস্বার্থে নয়, এক বিরাট আদর্শে লড়ছেন—তাঁদের লড়াইকে আমরা হারতে দিতে পারি না। আমরা তো আপনাদের মানসচেতনার প্রতিবেশী, একই পৃথিবীর অধিবাসী, পৃথিবীজুড়ে একই আদর্শের প্রত্যাশী।
মানব ইতিহাসে এক বিরাট ব্যাপার ঘটতে চলেছে। আমরা ধৈর্য হারাবো না, বিশ্বাসে অটুট থাকবো—দৃঢ় পদক্ষেপে আমরা জয়ের দিকে এগিয়ে যাবো।
জয় বাংলা; জয় মনুষ্যত্ব!

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল