You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.26 | ওঁরা মরণজয়ী —শ্রী দিলীপ কুমার দাস | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

ওঁরা মরণজয়ী
—শ্রী দিলীপ কুমার দাস

পৃথিবী চলছে অবিরাম গতিতে—কখনো তার বিরাম নেই। এই চলমান গতিশীলতাই তার জীবনী শক্তি। আমরাও চলছি পৃথিবীর আবর্তনের সাথে সাথে। জীবনের জন্মলগ্ন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত এমনি ভাবে কালের চাকার অবিরাম গতির সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলছি; পিছিয়ে কেউ পড়ে থাকতে চায় না আর থেকে লাভও নেই। আজ কেন যেন ‘তেঁতুলিয়ার’ কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে—ওর ভাঙন সৃষ্টিকারী ঢেউগুলোর মধ্যে এক নূতন ভিত গঠনের ইঙ্গিত আমি দেখতে পাচ্ছি। আজ যা কল্পনা, কয়েক দিন আগেও তা ছিল আমার কাছে এক জীবন্ত বাস্তব—যারা ছিল একদিন একান্ত কাছের মানুষ আজ তারা অনেকে শত শত যোজন পারে; সেখান থেকে আর কোন দিন কেউ ফিরে আসে না। সে-ও আর আসবে না। আমি, কবি ও দার্শনিকের ন্যায় সান্ত্বনা খুঁজি—পৃথিবীতে কিছুই নাকি শেষ হয়ে যায় না। পৃথিবীর ধূলো, কাদা ও মাটির সাথে সব কিছু মিলে মিশে একান্ত হয়ে যায়। প্রতিটি বছর যেমন নিত্য নূতন হয়ে দেখা দেয়, তার স্মৃতি ও আমার কাছে তেমনি নিত্য রঙ্গিন হয়ে প্রতিভাত। দেশ মাতৃকার মুক্তির জন্য যারা আত্ম ত্যাগ করে তাদের ন্যায় মরণ জয়ী গৌরবের আসন কে অর্জন করতে পারে? মৃত্যু তো চিরন্তন, এর হাত থেকে কেউ অব্যাহতি পাবেনা। তবে কেন একটা বড় কাজ করে সে মরণকে বরণ করবো না। মৃত্যু সব কিছু কেড়ে নিতে পারে কিন্তু পারে না খ্যাতিকে মুছে দিতে; সে যুগ থেকে যুগান্তরের হাতে পৌঁছে দেয় এক কালের কীর্তিগাথা অনাগত কালের কীর্তি স্থাপনে প্রয়াসী মানুষদের কাছে। তাহলে সেও মরতে পারে না। না! না! না! আমিন মরেনি সে বেঁচে আছে, বেঁচে আছে ভোরের আকাশে, সবুজ ঘাসের আস্তরণে, নীল আকাশের নীল নীলিমায় আর অফুরন্ত জীবন প্রবাহের মাঝে। আমিন, সেই দামাল ছেলেটি—কত আর বয়স হবে, ১৮/১৯ বছর। স্নাতক শ্রেণীর ছাত্র। কীর্তিমান ছেলে। দেশের কাজ, সমাজের কাজ, লাখ লাখ মুমূর্ষু নর-নারীর সেবার কাজ, একটা গোটা জাতিকে স্বাবলম্বী হয়ে দাঁড়াবার কাজে জন্মভূমির প্রিয় সন্তান তো নিজের ব্যক্তিগত সুখ সুবিধে ও সুখকর ভবিষ্যত তৈরীর জন্য নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকতে পারে না। আমিনও পারেনি। কাঁধে রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে পশু হানাদার বাহিনীর প্রতিরোধে।
তেঁতুলিয়া নদীর পাড়ে ছোট একটি গ্রাম, নাম তার সোনাহাটি। কবে কোন অনাদি কালে কে এই মিষ্টি মধুর নামটি রেখেছিল জানিনা, তবে সোনারহাট না হলেও ঘর আলো করা অফুরন্ত সুখ সৌন্দর্য এই গ্রামটিকে ঘিরে ছিল—আজো কালের সর্বগ্রাসী ক্ষুধা তার সবটুকু হরণ করে নিতে পারেনি। সোনাহাটির প্রতিটি গাছ, পাতা, লতা আর ধূলো মাটির সাথে তার অন্তরের একান্ত আত্মিক সম্পর্ক। সে বন্ধন কেউ কোন দিন ছিন্ন করতে পারে না—পাক হানাদার বাহিনী তো দূরের কথা মহাকালও সেখানে এসে থমকে দাঁড়ায়। হানাদার বাহিনী আধুনিক মার্কিন মারণ অস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে গোটা গ্রামটাকে ঘিরে ফেলেছে। তেঁতুলিয়ার বুকে আজ দস্যুদের ‘গানবোট’। গোলাগুলির বজ্রগম্ভীর শব্দে অকস্মাৎ সোনাহাটির আকাশ বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠছে। চোখের পলকে ছোট ছোট কুটীর গুলো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। যুগে যুগে মীরজাফরের দল জন্ম গ্রহণ করে আর ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। বিশ্বাস ঘাতক বেইমানেরা হানাদারদের খবর দিয়েছে—খবর দিয়েছে আমিনের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা সুসংগঠিত হয়ে আক্রমণ পরিচালনা করছে। হ্যাঁ, আমিন, আক্রমণ করেছে বাংলার শত্রু হানাদার পশুদের; আর যোগ্য সেনানীর ন্যায় পরিচালনা করছে ওর সহ-যোদ্ধাদের। এ যুদ্ধ হল বিপ্লবী বাংলাদেশের বীর সন্তানদের মুক্তি যুদ্ধ, যে মুক্তিযুদ্ধ কোন দিন ব্যর্থ হয়নি, হতে পারেনা। হয়তো সময় সময় থমকে দাঁড়ায় কিন্তু তারপর আবার প্রবল দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলে মুক্তির প্রান্ত সীমায়। এ সৈনিকরা তো লুটেরা ভাড়াটে বাহিনীর পশু নয় এরা হলো স্বাধীনতা কামী দামাল ছেলে যাদের একমাত্র লক্ষ্য স্বাধিকার অর্জন। মুক্তি যোদ্ধারা জানে স্বৈরাচারী শাসক ও শোষকের দল কখনো স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছেড়ে দেয় না; ওদের ধ্বংস করে ক্ষমতা কেড়ে নিতে হয়। তাই এই সংগ্রাম কঠিন, কঠোর এবং দীর্ঘস্থায়ী। গ্রামের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে আর্তচিৎকার ভেসে ওঠে। নির্বিচারে নরপশুরা হত্যা করে চলেছে নিরীহ গ্রামবাসীদের, যাদের গায়ের ঘাম ঝরানো আর বুকের রক্ত নিঙড়ানো পরিশ্রমে ফলানো ফসল দিয়ে পাক জল্লাদদের মোটা বিদেশী মুদ্রা সংগৃহীত হয়। মা বোনেরা ইজ্জত রক্ষার জন্য বুক ফাটা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। নিরীহ গ্রামবাসীদের নির্বিচারে হত্যা ও ধর্ষিতা নারীর বুক ফাটা আর্তনাদে মুক্তি যোদ্ধারা গুপ্ত ঘাঁটিতে চুপ করে থাকতে পারেনা। গেরিলা কায়দায় চার পাঁচজন করে চারটে দলে ভাগ হয়ে হানাদার পশুদের আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হল। ওরা বুঝিয়ে দিতে চায়, “সাবধান! নরপশুর দল, আর হত্যা করার চেষ্টা করো না। আমাদের মা বোনদের ইজ্জত হরণ করার চেষ্টা করলে কুকুরের মত তোমাদের হত্যা করবো!” চারদিক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে রাইফেল আর হাল্কা মেসিনগানের গুলি হানাদারদের আক্রমণের জবাব দিতে আরম্ভ করল। পাক পশুরা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। সারাদিন ধরে এই ভাবে চললো গুলি বিনিময়। একশোর উপর খান সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে—পশুদের উষ্ণ তাজা রক্তে সোনাহাটির মাটি তর্পন করছে। এক সময় পশ্চিম দিকের মুক্তি যোদ্ধাদের গুলি চালনা থেমে যায়। এই সুযোগে অবশিষ্ট হানাদাররা গানবোটে পালিয়ে গেল : পেছনে ফেলে গেল ১০/১২ খানা গানবোট ও অসংখ্য আধুনিক মারণাস্ত্র।
সন্ধ্যা সমাগত। পশ্চিমের আকাশ লালবর্ণে উদ্ভাসিত। তেঁতুলিয়ার নীল জলে অস্তগামী সূর্যের লাল আভা টলমল করছে। ক্রমাগত রাত গভীর হয়ে আসে। দ্বিতীয়ার ক্ষীণ চাঁদ আধো আলো নিয়ে দেখা দিয়েছে—সুন্দর আকাশের তারাগুলো মিট মিট করে জ্বলছে। তেঁতুলিয়ার পাগলা ঢেউগুলো ছলাৎ ছলাৎ শব্দে কূলে এসে ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছে। শ্যামলের ডাকে ইয়ুসুফ, জামাল, কামাল, মিন্টু, রতন ও অন্যান্য সব মুক্তি যোদ্ধারা পশ্চিম দিকে ছুটে যায়। সহযোদ্ধাদের মুখে কথা নেই অথচ দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ প্রত্যেকের চোখে মুখে ফুঠে উঠেছে। আমিনের রক্তাপ্লুত অসাড় দেহটা শ্যামলের কোলে চিরনিদ্রায় শায়িত! ভারি মেসিন-গানের গুলি বুকটাকে ভেঙ্গেচুরে দিয়েছে। তখনো যেন আমিনের মুখে লেগে আছে এক প্রশান্ত হাসি। সে-হাসি মৃত্যুকে যেন তাচ্ছিল্য করছে—যেন বোঝাতে চাইছে, মরণকে আমি ভয় করি না। সত্যিইতো, মরণকে সে ভয় করেনি, বীর সৈনিকের ন্যায় মরণকে বরণ করেছে—পালন করেছে দেশের মুক্তির মহান কর্তব্য। আমিন মরেনি, আমাদের মাঝে ও বেঁচে আছে—বেঁচে আছে বাংলার মাটির সাথে, মিশে আছে তেঁতুলিয়ার উদ্দাম তীর-ভাঙ্গা ঢেউগুলোর সাথে, যা কোনদিন বাংলা মায়ের কাছ ছাড়া হবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে আবার সবাই ফিরে যাবো—ফিরো যাবো সেই ছোট গ্রাম সোনাহাটিতে। সেদিন সশ্রদ্ধ সম্মান জানাবো সোনাহাটির মরণজয়ী বীরকে—গ্রামের দক্ষিণ দিকের বড় বকুল গাছটার নীচে যে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে। অজস্র ঝরা বকুল ফুল কবরটাকে ঢেকে রেখেছে। মিষ্টি-মধুর গন্ধে মাতোয়ারা মৌমাছি উড়ে বেড়াচ্ছে গাছটাকে ঘিরে। আমিনের প্রিয় সাথীরা তার কাজ ভাগ করে নিয়েছে—বাংলার বুকে আজ অসংখ্য আমিন তৈরি হয়েছে পশু হত্যার মহান ব্রতে। বাংলার শহরে, গ্রামে, গঞ্জে, নগরে, বন্দরে, মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তৎপর—সর্বত্রই হানাদার দস্যুরা কোণঠাসা হয়ে গেছে—গেরিলাদের প্রচন্ড আক্রমণে ওরা সব সময় ভীত-সন্ত্রস্ত! আজ ছোটখাটো মতবিরোধ ভুলে গিয়ে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করার দিন এসেছে। যারা কেড়ে নিয়েছে আমাদের প্রিয় সাথীদের, লুটে নিয়েছে মা বোনদের ইজ্জত, তাদের যেন আমরা কেউ কোনদিন ক্ষমা না করি।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল