You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.19 | বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ কি এবং কেন? —মোহাম্মদ আলী খান | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ কি এবং কেন?
—মোহাম্মদ আলী খান

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
সুখের বিষয় গণপ্রজাতিন্ত্রক বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বে মুক্তি বাহিনীর জয় অবশ্যম্ভাবী। অদম্য মনোবল নিয়ে অসম সাহসের সঙ্গে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছেন। তাঁরা বিভিন্ন রণাঙ্গনে জয়লাভ করে চলেছেন। বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ মুক্তির জন্য তাঁরা সবরকম কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করে এগিয়ে চলেছেন। আমাদের শ্রমিক, ছাত্র-যুবকদের নিকট আমাদের আবেদন,—জাতিধর্ম নির্বিশেষে আপনারা এগিয়ে আসুন—মুক্তিবাহিনীতে তালিকাভুক্ত হোন। আজ সীমান্তের ওপারে ভারতে লক্ষ লক্ষ সংখ্যক শরণার্থীর সর্বপ্রকার প্রয়োজন মেটান ভারতের পক্ষে এত অল্প সময়ে অসম্ভব হয়ে উঠেছে, তার উপর দিন দিন শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিশ্বাসঘাতক, নরখাদক পাকিস্তান সরকারের জেলে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান সাহেব বন্দী হয়ে বিভিন্ন প্রকার শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার ভোগ করছেন। বাংলাদেশের হানাদার দখলকৃত অঞ্চলে আমাদের মা-বাপ, ভাই বোন, স্ত্রী-পুত্র আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শত শত অত্যাচার, ভয়-ভীতির মধ্যে তারা আমাদের মুখ চেয়ে বসে আছে। কবে আমরা বিজয়ীর বেশে মার কাছে যাব—বোনের পাশে দাঁড়াব। কুলবধূ ছোট ছোট পুত্র কন্যা নিয়ে কত ভয় ত্রাসের মধ্যে বসবাস করছে। এদের স্মরণ করে আরামকে হারাম করে বর্তমানের সমস্ত সুখ শান্তিকে, ভয়-ভীতিকে উপেক্ষা করে একটি মাত্র শপথ নিতে হবে—একটি মাত্র ধ্যান করতে হবে। বাংলাদেশে বিদেশী হানাদারদের খতম করে বাংলার মানুষকে চির দিনের মত শোষণ মুক্ত করা।
ওঠ, জাগো বাংলার যুব সমাজ। আজ আমাদের সম্মুখে প্রাণ প্রিয় দেশ মাতৃকা শত্রু হামলায় লুন্ঠিত। মা, বোনদের ইজ্জত আজ অপমানিত। কি হবে যৌবনের এই রক্ত দিয়ে? সর্বহারা অসহায় মানুষগুলো আজ জীবন বাঁচানোর জন্য আশ্রয় ‍খুঁজে পাচ্ছে না। বিপ্লবী প্রেরণা নিয়ে এদের পাশে দাঁড়াতে হবে। এদের বাঁচাতে হবে। যৌবনের উত্তপ্ত রক্ত, প্রতিরোধী মন, দেশকে মুক্ত করার প্রচন্ড বাসনা নিয়ে নরখাদক দস্যুদের খতম করতে হবে। অত্যাচারী শোষকেরা আমাদের প্রাণপ্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশে অত্যাচার শোষণ ও নির্মম হত্যাকান্ড চালিয়ে বিশ্বের সমস্ত অত্যাচারের ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে। আমরা বাঙালীরা মুক্তিযুদ্ধের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করব। কাপুরুষের মতো শত্রুর হাতে ধরা পড়ে মৃত্যু বরণ করব না। শোষক নরখাদক হানাদার পশুদের রণক্ষেত্রে এমন জবাব দেওয়া হবে যার ইতিহাস নিয়ে আমাদের ভবিষ্যত বংশধরেরা গৌরব করতে পারবে এবং বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। মুষ্টিমেয় দালাল ও বিশ্বাসঘাতক আমাদের স্বাধিকার আদায়ের রক্তপিচ্ছিল পথে বার বার শোষক অত্যাচারী বেইমানদের সঙ্গে সহযোগীতা করে, দালালী করে, আমাদের মৃত শবের উপর বিলাসের প্রাসাদ রচনা করতে চেয়েছে,—ওদেরকে চরম আঘাত করুন, ওদের নির্মম ভাবে খতম করুন, বাংলার মাটি চিরদিনের জন্য পবিত্র করুন।
মুক্তি যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক কার্যকলাপ খুব বেশী প্রয়োজন। আমাদের পৌঁছতে হবে গ্রামে গ্রামে, বলতে হবে কি তাদের করণীয়। তাদের প্রাণে জাগাতে হবে বল ও ভরসা। তাদের সংগঠিত করতে হবে এবং তাদের মধ্যে থেকে গেরিলা সৈন্য সংগ্রহ করতে হবে।
শুধু বুলেট চালান বা যুদ্ধ কৌশল প্রশিক্ষণ নয়, চারিত্রিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। মুক্তি যোদ্ধার অস্ত্র ব্যবহৃত হবে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে, বঞ্চিত—অবহেলিত মানুষের মুক্তির জন্য। সংকীর্ণ ব্যক্তি স্বার্থ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। দেশের স্বার্থ ও জাতীয় স্বার্থের মাধ্যমে নিজ স্বার্থ খুঁজে পাবে।
যৌবনের দুর্বার শক্তি সাহস নিয়ে এগিয়ে চলুন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাসকে আজ নিপূণভাবে পর্য্যালোচনার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে হবে। কারো ভুলের জন্য অলসতার জন্য আমরা অপেক্ষা করতে পারিনা। দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলুন। মনে রাখতে হবে সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য এবং আদর্শের জন্য রক্ত দিতে পারলে বন্যার ন্যায় সুখ, শান্তি নেমে আসবে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ইতিহাস ছাত্র-যুবকদের রক্তে মহীয়ান হয়ে রয়েছে। তাদের উত্তপ্ত রক্তের বিনিময়ে কত দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শোষণহীন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা। বিশ্বের ইতিহাস; জ্ঞান, বিজ্ঞানে তারা কত কি দান করে নিজেরাও ধন্য হয়েছে বিশ্বকেও ধন্য করেছে। তাই আসুন আমরাও দেশ ও জাতির মহা পরীক্ষার দিনে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে হানাদারদের খতম করে মুক্তির পথ ত্বরান্বিত করি।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল