বিপ্লবী বাংলাদেশ
১৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
নিজের রক্তে কলঙ্ক মুছে দিয়েছে
—মিন্টু বসু
(জাহানারার পরিচয় বিশেষ কারণেই গোপন রাখতে হল বলে আশাকরি পাঠক-পাঠিকা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে গ্রহণ করবেন আমাকে।)
জাহানারা আরজুকে আমি এর আগে কোনদিন দেখিনি। সেই প্রথম দেখা। জাহানারার নাম শুনেছি। ওর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতাম। তাই সেদিন ধূসর গোধূলি লগ্নে জলাকীর্ণ বীলে জাহানারাকে দেখে সত্যি আশ্চর্য না হয়ে পারিনি। অবশ্য আশ্চর্যের কিছু ছিল না। যেহেতু বাংলার মানুষ তখন ক্ষুধার্ত হায়ানার গ্রাস থেকে বাঁচবার জন্য গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ছুটে চলেছেন। তবু সেদিন জাহানারাকে দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারিনি।
বাংলার আকাশ তখন লালে লাল। যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি আগুনের লেলিহান শিখা। পাক বর্বর দস্যুরা একের পর এক গ্রাম ধ্বংস করে দিচ্ছে আগুন দিয়ে। খান সেনাদের নৃশংস অত্যাচারে বাংলার মাটি পর্যন্ত কেঁদে উঠেছে। এমন সময়ে জাহানারার মত একটি বিচক্ষণা বুদ্ধিমতী মেয়ের আবির্ভাব একটু অস্বাভাবিক বৈকি।
আমরা থাকতাম তখন বরিশালের সাতলার বিলে। তিনখানা নৌকায় বারোজন। বরিশালের পতন হবার পর আমরা বারোজন মুক্তি ফৌজ দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার মাস ধরে এখানে এসে আত্মগোপন করেছিলাম। অস্ত্র ছিল কিন্তু গোলাবারুদ ছিলনা। তাই এই বীলের মধ্যে থেকেই খোঁজ নিচ্ছিলাম কি ভাবে যোগাযোগ করা যায় আমাদের অন্যান্য দলের সঙ্গে।
সেদিন আমরা সবাই বসেছিলাম। নৌকার উপর, সন্ধ্যা আগত, আকাশ লাল, বসে বসে দেখছিলাম পাক সৈন্যদের পৈশাচিক নৃশংসতা। ভোর থেকে শুরু হয়েছে বর্বর গুলোর পৈশাচিক উল্লাস। সাতলার বীলে বসে দেখছিলাম অদূরের গ্রামগুলো দাউ দাউ করে জ্বলে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। আর শুনেছি মেশিন গানের শব্দ। দূর থেকেও অনুভবে বুঝতে পেরেছি ঐ এক একটি গুলী এক একটি নিরীহ মানুষকে শেষ করে দিয়ে যাচ্ছে।
বসে বসে শুধু আক্রোশে ফুঁসছিলাম! কি করব? এ নৃশংসতা যে আর সহ্য করা যায়না। সবাই নিঃশব্দে বসেছিলাম। হঠাৎ মিলনের কথায় সবাই চমকে উঠেছিলাম—আমাদের জাহানারার মত বলে মনে হচ্ছেনা?
মিলনের কথায় ফিরে তাকিয়েছিলাম অদূরের ছোট্ট পথটার দিকে। দেখলাম আলুলায়ীত বেসে একটি মেয়ে ছুটে আসছে, রুক্ষ চুলগুলো বাতাসে উড়ছে। দেখতে দেখতে সে এগিয়ে এসেছিল নৌকার কাছে। এর মধ্যে আমরা সবাই নৌকা থেকে নেমে পড়েছিলাম। মিলন এগিয়ে গিয়ে জাহানারাকে ধরে ফেলেছিল। তারপর একের পর এক প্রশ্ন করেছিল—এখানে এলে কি করে? কোথা থেকে এসেছো? তোমার বাবা-মা, ভাইরা কোথায়? ইত্যাদি।
অনেকক্ষণ পর শুধু একটি কথাই বলেছিল, বাবা-মা মারা গেছে, ভাইদের সংবাদ জানেনা।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম জানাহারাকে। মুখে কথা নেই কিন্তু চোখ থেকে যেন ঠিকরে আগুন বেরুচ্ছে। যেন ঝড়ের দাপটে এলিয়ে পড়া একটি বিরাট বৃক্ষরাজ। হঠাৎ ভীষণ রকম চমকে উঠেছিলাম। যুবতী জাহানারা অন্তঃস্বত্বা। জাহানারার সমস্ত শরীরে এ ছাপ পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। বুঝতে আর বাকী ছিলনা তখন, জাহানারা খান সেনাদের শিকারে পরিণত হয়েছিল।
পরে একদিন কথায় কথায় জাহানারা বলেছিল, তার বাবা-মাকে মেরে তাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ক্যান্টনমেন্ট। চারদিন আটকে রেখেছিল। চার দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে জাহানারা বলেছিল, বর্বর পাক সেনারা তাকে সবসময় উলঙ্গ করে রাখত। যখন তখন জাহানারার উপর ক্ষুধার্ত পশুগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ত। জীবনের এতবড় কলঙ্কের কথা বলতে গিয়ে কখনো কাঁদেনি জাহানারা। এমনকি এতটুকু দুঃখ প্রকাশও করেনি? শুধু দেখতাম চোখ দিয়ে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বেরোচ্ছে। কয়েকদিন পরে একদিন জাহানারাকে তার আত্মীয় স্বজনদের ঠিকানা দিতে বলেছিলাম। সেখানে ওকে পৌঁছে দেবার জন্য। কিন্তু উত্তরে সে বলেছিল, সে দেশমাতৃকার নামে জীবন উৎসর্গ করেছে।
এরপর জাহানারা রয়ে গেল আমাদের মাঝে একজন মুক্তি সংগ্রামী হয়ে। এর কয়েকদিন পরেই শত্রু সৈন্যরা সাতলার বিলে চড়াও হল। গোলাবারুদ ছিলনা যে মোকাবিলা করব। শেষে বাধ্য হয়ে জংগলে লুকোতে হল। নৌকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র গুলো নিয়ে নৌকাগুলোকে ডুবিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমাদের কোন চিহ্ন না থাকে।
সমস্তদিন ধরে সেদিন সাতলার বীলটাকে খান সেনারা চষে বেড়াল। আমাদের খোঁজ দেবার জন্য অনেক মানুষকে গুলী করে মারল। কিন্তু আমাদের খোঁজ কেউ দিতে পারেনি।
তখন বিকেল চারটে, জংগলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম পাকসৈন্যরা এদিকেইে এগিয়ে আসছে। নিঃশব্দে সবাই বসেছিলাম। নিজের নিশ্বাসের শব্দ নিজেই শুনতে পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ দেখলাম আমাদের সামনে দিয়ে এক এক করে চলে যাচ্ছে আমাদের মুখের গ্রাস। ব্যর্থ আক্রোশে সবাই ফুলকি হঠাৎ এমন সময় সবাই ভীষণ রকম চমকে উঠলাম। দেখলাম জাহানারা ছুটে চলছে হাতে তার বেয়নেট। রাইফেল থেকে বোধহয় খুলে নিয়েছিল, নিশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম আমাদের। পরিণতি ভেবে বার বার আমরা শিউরে উঠছি। একি করতে যাচ্ছে জাহানারা? অধিক আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম। খান সেনারা এক লাইন ধরে এগিয়ে চলছে আর পেছনে জাহানারা নিজেকে জংগনের আড়ালে আত্মগোপন করে এগিয়ে যাচ্ছে। একসময় জাহানারা অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল লাইনের পেছনের সৈন্যটার উপর। হাতের বেয়নটটা বসিয়ে দিতে মুহূর্তও দেরী করলনা। একটা আর্তচিৎকার! খান সৈন্যরা সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল কিন্তু তার আগেই জাহানারা হাতে বেয়নটটা নিজের নাভিস্থলে সজোরে বসিয়ে দিল। লুটিয়ে পড়ল জাহানারা।
তারপর দেখলাম খানসেনারা ওদের লাশটাকে কাঁধে তুলে নিল আর জাহানারার চুলগুলো ধরে টেনে নিয়ে দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।
জাহানারা হারিয়ে গেল! দেশমাতৃকার নামেও জীবন উৎসর্গ করেছিল। সে পণ ও জীবন দিয়ে রক্ষা করে গেল। খান সেনাদের কলঙ্কের বোঝা আর বোধহয় ও বহন করতে পারছিলনা। তাই বুঝি ভিতরে ভিতরে চলছিল প্রস্তুতি। আর সে প্রস্তুতি ফলপ্রসূ হল। খানসেনার কলঙ্ক নিজের রক্তে মুছে দিল জাহানারা!
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল