You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ কি এবং কেন?
মোহাম্মদ আলী খান

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর হতে বাংলাদেশের মানুষ চরম অত্যাচার শোষণ, ও উৎপীড়নের বিরুদ্ধে প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্য অর্জনের মানসে গণতান্ত্রিক অধিকার, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অগ্রগতি সাধনের জন্য অবিচল প্রচেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। দীর্ঘদিনের এই স্বাধিকার আন্দোলনকে পরিচালনা করতে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতা অত্যাচার, নিপীড়ন, লাঞ্ছনা, নিষেধাজ্ঞা, গ্রেপ্তার, এবং সামরিক আইনের বহু বাধাকে উপেক্ষা করেছে। বাংলার জনগণের ইস্পাত কঠিন দৃঢ়তাকে ধ্বংস করার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল জালেমরা বারবার ট্যাঙ্ক, কামান ও বোমারু বিমান ব্যবহার করে ব্যাপক নরহত্যা ও ধ্বংসের প্লাবন বইয়ে দিয়েছে। অত্যাচারী নরখাদক বর্বর পশুর দল নির্মমভাবে হত্যা করেছে লক্ষ লক্ষ নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুকে, লক্ষ লক্ষ বাড়ী-ঘর পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে। ওরা লুট করে নিয়েছে আমাদের সুখের সংসার—শ্মশান করেছে সোনার বাংলা—ধ্বংস করেছে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য—ভেঙ্গে দিয়েছে অর্থনৈতিক কাঠামো।
গণপ্রতিনিধিগণ কখনও পাকিস্তান হতে বাংলাদেশকে বিচ্ছিন্ন করতে চাননি। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে স্বায়ত্বশাসনের দাবিকে অস্বীকার এবং নির্মম ভাবে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে বর্বর সামরিক আক্রমণ সুরু করার পরেই তাঁরা গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করেন।
তাই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দুর্জয় বিপ্লবী সংগ্রামে লিপ্ত। এই বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালীরা তাদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চূড়ান্ত রূপ দেবে।
যুগে যুগে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আপামর জনসাধারণ অত্যাচার, অন্যায়, জালেম, শোষকের বিরুদ্ধে নিরুপায় হয়ে মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আজও কয়েকটি দেশে সাম্রাজ্যবাদী, স্বৈরাচারী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে প্রচন্ড-মুক্তিযুদ্ধ ঘোষণা চলছে। আমরা বাঙালীরাও বিশ্বের ইতিহাসের চরম শিক্ষাকে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছি, ভবিষ্যতেও অত্যাচারিত শোষিত মুক্তিকামী মানুষ তার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য এই চরম ও পরম পথকে বেছে নিতে বাধ্য হবে।
মুক্তিযুদ্ধ কি? মুক্তিযুদ্ধ কেন? কি ভাবে মুক্তিযুদ্ধে জয়যুক্ত হতে হয়—এ কথা বুঝতে পারলে, শিখতে পারলে যতদিনই মুক্তি চলুক না কেন, যত বাধাই আসুক না কেন, তা দেখে কোন দিন হতাশ হয়ে পড়ার কারণ নেই। মানুষ তখনই হতাশ হয়ে পড়ে, যখন সে এমন কিছুর সম্মুখীন হয় যা তার কাছে অপ্রত্যাশিত। যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধার মনে একটা সুস্পষ্ট ধারণা থাকে তবে মুক্তির পথে চলতে কোনদিনই তারা নিরাশ হয়ে পড়বে না। যতই তাদের ধারণা সুস্পষ্ট হবে, ততই তাদের প্রেরণা বাড়বে। ভাবাবেগের দ্বারা মুক্তিযুদ্ধ হয় না, রাইফেল চালাতে জানলেই মুক্তিযোদ্ধা হওয়া যায়না। মুক্তিযোদ্ধাকে মনে প্রাণে অবশ্যই বিপ্লবী হতে হবে। কেন আজ তাকে এই চরম-পরম পথকে বেছে নিতে হয়েছে তা ভাল ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে। বিপ্লবী যোদ্ধার বড় অস্ত্র হচ্ছে তার বৈপ্লবিক প্রেরণা—তার বৈপ্লনিক কর্মতৎপরতা। বিপ্লবী যোদ্ধাকে অস্ত্র হাতে তুলে দিতে হয় না—শত্রুর কাছ থেকে বিপ্লবী অস্ত্র কেড়ে নেয়।
ইংরেজী ভাষায় revolution মানে পরিবর্তন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে কোন পরিবর্তনকেই কি বিপ্লব বলা চলে? একটি গভর্নমেন্টের পরিবর্তন বা মন্ত্রীদলের পরিবর্তনকে কি বিপ্লব বলব? পাকিস্তানের আইয়ুব খাঁর গদী পরিবর্তনকে কি বিপ্লব বলব? না, এ সব বিপ্লব নয়। কারণ এতে জাতীয় জীবনধারার পরিবর্তন ঘটে না। জাতীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনের গণমুখী পরিবর্তন ঘটেনা। আইয়ুব খাঁ জনগণের দেওয়া চাকরী, অস্ত্রশস্ত্র, জনগণের কষ্টার্জিত অর্থে গড়া সৈন্য বাহিনীকে অপব্যবহার করেছে নিজের এবং শোষক দুর্নীতিপরায়ণ ব্যবসায়ী ও সরকারী কর্মচারীদের স্বার্থে। জাতীয় জীবনে গণমুখী মূলগত পরিবর্তন ঘটেনি।
বিপ্লবের ফলে যে পরিবর্তন আসে তা মূলগত পরিবর্তন। জনগণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক, চারিত্রিক জীবনের মূলগত পরিবর্তনে নিয়মতান্ত্রিক, স্বাভাবিক পথ যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন নির্য্যাতিত, বঞ্চিত মানুষকে অস্ত্রধারণ করে বিপ্লবের পথে সমস্ত বাধাকে ধ্বংস করে এগিয়ে যেতে হবে—শোষণের সমস্ত উৎস মুখ ধ্বংস করতে হবে—জাতীয় শত্রুদের নির্মূল করতে হবে। সেইজন্যেই রক্তপাত বিপ্লবের একটা অঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সামান্য ২/৪টি নগণ্য পরিবর্তনকে বিপ্লব বলা চলে না।
বাংলার মানুষ স্বাভাবিক পথে বাঁচতে চেয়েছিল—চেয়েছিল নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে শোষণের-অত্যাচার-অবিচার জুলুমের হাত থেকে রেহাই পেতে। কিস্তু প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তান সরকার এবং তাদের তল্পিবাহক দালালেরা বার বার সে নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের পথে বিভিন্ন কায়দায় বাধার সৃষ্টি করেছে এবং এবং নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে সংগ্রাম বন্ধ করার চেষ্টা করেছে। তাই বাংলার জনগণের রাজনৈতিক মুক্তি এবং শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা গঠনের জন্য অস্ত্র হাতে গর্জে উঠতে বাঙালীরা বাধ্য হয়েছে। দেশীয় শাসকবর্গের বিরুদ্ধে বিপ্লব সৃষ্টি করে নতুন সমাজ ব্যবস্থার জন্য বিপ্লব করা অপেক্ষাকৃত সহজ কাজ কিন্তু প্রথমে বিদেশী শক্তিকে অপসারিত করা এবং তারপর নতুনতর সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি করা সত্যিই আর কঠিন কাজ। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখে তাই আজ কঠিন অগ্নিপরীক্ষা। প্রথমঃ বিদেশী পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে বিতাড়িত করা, দ্বিতীয়তঃ বাংলা দেশের বঞ্চিত অবহেলিত মানুষের জন্যে শোষণহীন সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি করা। (ক্রমশঃ)

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!