বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
ন্যায়ের প্রতিষ্ঠায় আজ এই নবজাগরণ
—সুধীর চৌধুরী
লাঞ্ছিতা লুন্ঠিতা বাঙলা মায়ের সন্তানেরা আজ জেগে উঠেছে। অন্যায়ের মধ্যদিয়ে নির্যাতনের মধ্যদিয়ে আজ তাদের জাগরণ ঘটেছে।
অত্যাচারের অন্ধকারাগৃহ ভেদ করে দেখা দিয়েছে একতার সূর্য্যালোক। আজ তাই বাংলাদেশের বক্ষচিরে বাঙালীর জীবনে ঘটেছে নতুন সূর্যোদয়।
ক্ষীণ বাঙালী, দুর্ব্বল বাঙালী, ভীরু বাঙালী আজ গ্রহণ করেছে মরণজয়ী শপথ। পশ্চিম পাকিস্তানী শোষকদের রক্তচক্ষুকে সে আর সহ্য করবেনা। দালালদের পাতা ফাঁদে সে আর পা দেবেনা, ইয়াহিয়া পশু বাহিনীর ভয়ে সে আর নিজেকে লুকিয়ে রাখবেনা।
শ্যামল তৃণে আবরিতা দেশজননী-পত্রপুষ্প সুশোভিতা রূপসী বঙ্গভূমি, সুনীল গগন তলে মেঘনা পদ্মা প্রবাহিতা সোনার বাঙলা-মা-আজ আহ্বান করেছে তার সন্তানদের। আহ্বান জানিয়েছে তার বীরপুরুষদের—আমার নির্য্যাতিত সন্তানেরা—ওঠো—জাগো-সোজা হয়ে দাঁড়াও। ভীতির দেওয়াল, ভীরুতার দেওয়ালকে ভেঙ্গে ফেলে দিয়ে মুক্ত করো তোমাদের সাড়ে সাত হাজার লক্ষ-ভাই ভগ্নীর জন্মভূমি মা’কে।
সর্ব্বস্ব পণ করে এগিয়ে আসো—দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ হয়ে প্রতিজ্ঞা করো তোমাদের জননীর বুকে যে আঘাত করেছে, অত্যাচার অবিচারের তরবারি হেনে তাঁর কলিজার রক্তে যে মেঘনা পদ্মা ধলেশ্বরীর বক্ষ লাল করে দিয়েছে তাকে তোমরা ক্ষমা করোনা। তাকে তোমরা নিঃশেষ করো বাঙলার মধ্যে থেকে। তাকে তোমরা দূর করে দাও বঙ্গোপসাগরের তীরভূমি থেকে।
দেশ জননীর এই আকুল আবেদন ব্যর্থ হবেনা,—পাকিস্তানী জল্লাদদের হাতে মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে-ধর্মান্ধ ভেদবুদ্ধির শেকল ছিঁড়ে ফেলে বাঙালী জাতি আজ ঝাঁপিয়ে পড়েছে—শত্রু খতম করবার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে।
বাঙালীর স্বাধীনতা হরণকারিদের বিরুদ্ধে-বিদ্রোহী-রাজা শেখ মুজিবের আদর্শে অনুপ্রাণিত বাঙালী জাতি আজ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামে লিপ্ত। জাতীয়তাবাদের নবদিগ্বলয়ে সে আজ কবর রচনা করবে পাকিস্তানী চমূ সর্দ্দারদের।
শেখ মুজিবের ভাবাদর্শে উদ্বেলিত বাংলাদেশের এই গণজাগহরণে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদের এই অভ্যুদয় প্রভাতে-পশ্চিমা পুঁজিবাদ ও বর্বর শাসকচক্রের বিরুদ্ধে যাঁরা আজ মরণপণ সংগ্রামে প্রদীপ্ত-তাদের কাহিনী লিপিবদ্ধ হবে ইতিহাসে স্বর্ণালী অক্ষরে।
তাই বাংলাদেশে প্রতিটি বাঙালীর গৃহ আজ পরিণত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের দুর্গরূপে। শেখ মুজিবের আহ্বান এবং আওয়ামী লীগের নির্দেশে—ধীর-শান্ত ও অতিথি পরায়ণ বাঙালী জাতি আজ পরিণত হয়েছে শত্রু হননকারী যোদ্ধায়।
শত্রুর প্রলোভন অথবা ভয়ে এখনো যারা খুনী ইয়াহিয়া এবং তার তাঁবেদার গোষ্ঠীর কাছে বাঙালীর সত্ত্বা বিক্রয় করে আত্ম প্রবঞ্চনা করছে—সেই সব পদলেহী কাপুরুষ—বাঙালী জাতির স্বাধীনতা বিরোধীদের ইতিহাস ক্ষমা করবেনা। ইতিহাস যদিও ক্ষমা করে বাঙলার বীর সন্তানেরা কখনো ক্ষমা করবেনা।
সোনার বাঙলাদেশকে যে সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী পশুরা আজ কবরে পরিণত করে চলেছে—ইতিহাস ক্ষমা করলেও মুক্তি বাহিনীর জোয়ানরা কখনো তাদের ক্ষমা করবেনা।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে স্বাধীন বাঙলাদেশ ও তার গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারকে রক্ষার জন্যে যুদ্ধের দামামা বাজছে। বাংলাদেশের তরুণ কবির ভাষায়
জীবন মৃত্যু তুচ্ছ সকল মায়ের অশ্রুজলে
লক্ষ ছেলের বক্ষপাঁজর জ্বলছে বজ্রানলে।
মহাকাল তাই আজ ডেকে বলছে বাঙালীর মৃত্যু নেই, স্বাধীন বাংলাদেশের পতন নেই, দেশ জননী এবং জাতির হৃদয়-সূর্য শেখ মুজিবকে মুক্ত করার অঙ্গীকারে সংগ্রামী বাঙালী মাত্রেই আজ মৃত্যুঞ্জয়।।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল