You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

মুক্তি যোদ্ধার জীবনলিপি থেকে
নজরুল ইসলাম (চুন্নু)

(রংপুর রণাঙ্গন)
যুদ্ধ ক্লান্ত সৈনিক আমি, কিছুক্ষণ আগেও এখানে ভীষণ যুদ্ধ চলছিল, পূর্বের আকাশ লাল হতে আমাদের আক্রমণ শুরু হয়েছিল। এখন পূর্বের আকাশে আঁধার বোরখা পরে এগিয়ে আসছে, এই দীর্ঘ বারো-তেরো ঘন্টার একটানা যুদ্ধে এখন সবাই ক্লান্ত।
কিন্তু সমস্ত ক্লান্তি ছাপিয়ে সবার মনেই জয়ের আনন্দ, আমাদের জয় হয়েছে। পাক বর্বর দখলদারদের ঘাঁটি এখন আমাদের নিয়ন্ত্রণে। ঘাঁটির সামনে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা যেন হাসতে হাসতে বলছেন, বাংলার পতাকা বাংলার আকাশে চির উড্ডীন থাকবে। যত বাধাই আসুক দুর্জয় বাংলার দুর্বার সন্তানরা তা প্রতিরোধ করবে, ঘাঁটির সামনে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি খান সেনাদের মৃতদেহ পড়ে আছে। আমার সংগ্রামী বন্ধুরা বিশ্রাম নিচ্ছে। আমি পাক সেনাদের কাছ থেকে দখলীকৃত মেশিনগানের সামনে বসে পাহারা দিচ্ছি। ঠিক তো নেই কুকুরগুলো যেভাবে মার খেয়ে গেছে তাতে হয়ত আবার দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আমাদের উপর, তাই যদি হয় তার সমুচিত জবাব দিতে হবে।
সূর্য ডুবে গেছে, স্বর্ণসন্ধ্যার স্বর্ণ আভায় পৃথিবী লাল। কিছুক্ষণ পরে আঁধার আলোর পৃথিবীটাকে গ্রাস করবে, যেমন করে ইয়াহিয়া খান গ্রাস করেছে বাংলার লাখো লাখো সন্তানকে।
স্মৃতির পটে আবার ঝড় শুরু হয়েছে। অথচ কি আশ্চর্য্য আমি অতীত ভাবতে চাই না। তবু কেন আমার মনটাকে সেদিকেই টানে? কি হবে সে কথা ভেবে আজ আর? কবে কোন এক স্বর্ণসন্ধ্যায় দেখা হয়েছিল—চার চোখের মিলন হয়েছিল—ভাল লেগেছিল—ভাল বেসেছিলাম—দু’জনার মাঝের দূরত্ব দূর হয়ে বিরাট বাধার প্রাচীরটা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। সেসব কথা আজ আর ভেবে কি হবে? আজ আমি মুক্তি ফৌজ।
আমার জননী জন্মভূমি শৃঙ্খলিত। তাঁর মুক্তির জন্য প্রতিজ্ঞা নিয়ে মুক্তিসেনায় জীবন উৎসর্গ করেছি। আজ আমি সব কিছুর উর্ধ্বে, মুক্তিসেনায় জীবন উৎসর্গ করেছি। আজ আমি সব কিছুর উর্ধ্বে, আমার একমাত্র লক্ষ চূড়ান্ত বিজয়। না-না, আমি অতীতকে নিয়ে ভাবব না, কিছুতেই আমার মনের পটে স্মৃতিগুলোকে স্থান দেব না। অতীত আজ আমার কাছে মৃত, স্মৃতিগুলোকে সব দূর করে দিতে হবে মনের নিভৃত থেকে।
কি হবে ভেবে কোন একদিন স্বর্ণসন্ধ্যায় ভালবেসে ছিলাম একজনকে। বাংলাদেশের কত মানুষই তো কত জনকে ভালবেসে স্বপ্ন দেখেছিল। ঘর বাঁধার স্বপ্ন, কিন্তু কি হল? একটা ঝড় তো? হ্যাঁ একটা প্রচন্ড ঝড় এসে বাংলার ভালবাসার নীড়টাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল।
তারই প্রতিশোধ নেবার প্রতিশ্রুতি নিয়েছিল বাংলামাকে স্পর্শ করে। তাই আর কোন ভাবনা নয়। আর ভাববনা আমি। যে স্বর্ণসন্ধ্যায় একদিন তাকে পেয়েছিলাম আজকের এই স্বর্ণসন্ধ্যায় তার বিসর্জন হোক।
তুমি হারিয়ে যাও হে আমার জন্ম-জন্মান্তরের প্রেয়সী। এ জন্মে আমাদের নীড় রচনা করা হোল না, কিন্তু পরের জন্মে আমরা এই বাংলায় যেন জন্মগ্রহণ করতে পারি এই প্রার্থনা জানাও ঈশ্বরের কাছে। সেদিনের সেই মুক্ত বাংলায় আমরা ইতিহাস হয়ে ছুটে বেড়াব এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত।
সেই কি ভাল নয় প্রেয়সী আমার? আমার এ সিদ্ধান্তে তুমি আবার কেঁদ না যেন। আমি কিন্তু কাঁদিনি, কাঁদলে যে আমরা হেরে যাব, আমাদেরকে পাথরের মত কঠিন হতে হবে। গুরুম! গুরুম! হঠাৎ বিকট শব্দে চিন্তার জালটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। বুঝলাম পাক হানাদাররা আক্রমণ করেছে আমাদের ঘাঁটি। আর অপেক্ষা নয়। হাত কঠিন হয়ে উঠল। কর-কর-কর একটানা গুলি ছুটলো মেশিন গান থেকে। ততক্ষণে আমার বিপ্লবী বন্ধুরাও এগিয়ে এসেছে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!