You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

যৌবনের রং সবুজ
—বিষ্ণু দাস

বড় দুঃসহ এই ১৮ থেকে ২৫ বছরের বয়ঃসীমা। যৌবনের প্রারম্ভ আর পরিপূর্ণতা। ১৯৪৭ এর ১৫ই আগষ্ট আর ১৯৭১ এর ১৫ই আগষ্ট সত্যিইতো আগামী দিনের আরও বৃহত্তর ইতিহাস রচনা করে। ২৪ বছর আগে এমন দিনে ভারতের মাটীকে দ্বিখন্ডিত করে চেকপোষ্ট বসিয়ে সীমানা বেঁধে দেওয়া হয়েছিল তথাকথিত পাকিস্তানের। কিন্তু অগণিত মানুষের সীমাহীন হৃদয়, মন, তখন তারা নিশ্চয়ই দেখতে পায়নি, পেলে মনে হয় এমনটি হোতনা।
এ বয়স বড়ই ভয়ঙ্কর, বাধা মানেনা, সহেনা অন্যায়, থাকেনা ভয়, শুধু থাকে দৃঢ় প্রত্যয় আর আত্মবিশ্বাস। এই বিশ্বাসের ওপর ভিত করে জীবনের ২৪টি সুন্দর বছর কাটিয়েছে, মাটিকে আরও শক্ত করেছে। বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে প্রতিরোধ শক্তিকে দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর করেছে। শোষণ আর নিষ্পেষণ সহ্যও করেছে যেমন, ঠিক তেমন ভাবেই বাধা দিয়েছে সেই বস্তাপচা শাসনযন্ত্রের জঙ্গী সামরিক শাসকদের বারে বারে, বিভিন্ন আন্দোলন অর্থাৎ ভাষা আন্দোলন, সংস্কৃতির আন্দোলন আর মানুষের মত বাঁচার আন্দোলনের মাধ্যমে। পরোয়ানা জারী করেছে দানবরূপী শাসকদের দরবারে এই বলে “তোদের দিন ফুরিয়ে এসেছে”। আর জানিয়ে দিয়েছে আমাদের যৌবনের পরিপূর্ণতা এসেছে। সেই যৌবনের গাঢ় রক্ত দিয়ে নতুন মাটী তৈরী করব, সেই মাটীতে তোদের কবর দিয়ে উর্বরা শক্তিকে বাড়িয়ে নতুন চারা রোপণ করব। যে চারার শেকড় থাকবে গভীর থেকে গভীরে আর ডালপালা প্রসারিত হবে দেশ থেকে দেশান্তরে বন্ধুত্বের পসরা নিয়ে।
এই যৌবনের বিস্ফোরণ ঘটল ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চ। কাতারে কাতারে যুবক ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁদের আগামী দিনের সুন্দর রঙীন ভবিষ্যৎ গড়ার কাজে। অফিস, কাছারী, আদালত, বিদ্যালয় আর প্রতিটি গৃহে উড্ডীন হল স্বাধীন বাংলার সবুজ নিশান। শুরু হ’ল সবুজের অভিযান।
এ এক নতুন ইতিহাস। বিশ্ব ইতিহাসের পাতায় থাকবে স্বর্ণাক্ষরে। আর থাকবে অমর হয়ে সে ইতিহাসের প্রধান কারিগর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর।
ইয়াহিয়া ভেবেছিল নির্বাচনের জিগীর তুলে আর মিষ্টি মধুর বলি বলে জনপ্রিয়তা অর্জন করবে একদিকে, অন্যদিকে টিঁকিয়ে রাখতে তোমারই শাসন। নিশ্চিন্ত ছিলে জনপ্রতিনিধিদের কেউ চাইবেনা। কিন্তু আজ?
দেখলেতো? সে আশা তোমার কেবল দুরাশাই থেকে গেল। মানলোনা বাধা, তোমার মিষ্টি বুলি, আর কামান বেয়োনেটকে উপেক্ষা করে বুঝিয়ে দিলেন তিলে তিলে দগ্ধে যাওয়া সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে আর তোমার চাইনা,—অনেক সহ্য করেছি, এবার হিসেব নেব আমাদের ক্ষয়ক্ষতির।
কিন্তু হায় ইয়াহিয়া খান সাহেব, এবারও বুঝলেনা এঁদের মনের কথা, পাগলা কুকুরের মত ঝাঁপিয়ে পড়লে রক্ত পিপাসা মেটাতে।
শেয়ালে শকুনে হ’ল মিতালি। মায়ের কোল থেকে শিশু, স্ত্রীর পাশ থেকে স্বামী, পিতার কাছ থেকে পুত্রকে কেড়ে নিয়ে মেটাচ্ছ রক্ত পিপাসা। সর্বস্ব কেড়ে নিঃস্ব করে কায়েম করতে চাইছ এক লুটেরার রাজ। এ আর ক’দিন? ভুলে যাচ্ছ এ মাটীতে তুমিও জন্মেছ, এই মাটী তোমাকে ক্ষমা করবেনা কোনদিনই।
ভেবেছিলে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চোখের ঘুম কেড়ে নিয়ে থাকবে বহাল তবিয়তে। কিন্তু আজ তোমারও চোখে ঘুম নেই। চারদিক দেখছনা ফাটল? কটা ফাটলইবা বন্ধ করবে? চোখ মেলে দেখ তোমার বলতে আর প্রায় কেউ নেই। তোমার সে হু্ঙ্কারে আর কেউ ডরছেনা। বসে বসে স্মৃতিচারণ করো পুরোনো দিনের কথা, দর্পণে দেখ নিজের মুখ, আর একবার শুধু তাকাও বিশ্বের দিকে।
যে সাড়ে সাত কোটিকে সায়েস্তা করবার দিবা স্বপ্ন দেখেছ তুমি আজ আর সে—সাড়ে সাত কোটি নেই—বেড়ে গিয়ে হয়েছে কোটি—কোটি—কোটি….। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ প্রস্তুত হয়ে গেছে। তারা শুধু তোমায় ধিক্কার জানিয়ে ক্ষান্ত হবেনা, শান্ত হবেনা তোমার রণহুঙ্কার আর সেনানীদের দেখে।
জাননা? তারা তৈরী করেছে এক বিরাট চিতা, যার আগুন অনির্বাণ আর শিখা লেলিহান। ঐ চিতাই তোমায় স্বাগত জানাচ্ছে। ফুরিয়ে যাবে গোলা বারুদ—জেগেছে বিশ্বের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষ। ওরাই আছে আর থাকবেও ওরাই। চিরটাকাল।
ওরা অক্ষয় অব্যয়। ওরা থাকবে অমর হয়ে। তোমার পসরা গোটাও, আর সময় নেই।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!