You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.05 | জনযুদ্ধের জনশিক্ষা | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

জনযুদ্ধের জনশিক্ষা

জনযুদ্ধের দুটি দিক আছে। একটি হলো যারা সরাসরি লড়াই করবে, অর্থাৎ ‘কম্ব্যাট ফোর্স’ বা ‘কমান্ডো’। সংখ্যায় তারা জনগণের সামান্য অংশ। আর জনগণের বৃহদাংশ হলো ‘মোটিভেশনাল আর্মি।’ তারা জনগণকে বিপ্লব সম্বন্ধে সচেতন রাখে, জনগণের মনোভাব অবিচল রাখতে সাহায্য করে, শত্রুপক্ষকে ভুল বোঝায়, শত্রুপক্ষ সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করে, এবং সর্ব্বোপরি, কম্যান্ডোরা যাতে সবরকম সাহায্য পায় তার চেষ্টা করে। এইসব কাজকর্মের মধ্যে দিয়ে মোটিভেশনাল আর্মি জনগণের বিপ্লবী মনোভাব গড়ে তোলে। ফলে বিপ্লবের কাজ আরও দ্রুততর হয়। আর মোটিভেশনাল আর্মির কার্যকলাপের ওপর নির্ভর করে এগোতে থাকে কম্যান্ডোদের যুদ্ধ এবং অন্তর্ঘাতমূলক ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের তথা মুক্তিযুদ্ধেরও এই দুটি দিক রয়েছে। একটি হচ্ছে কম্যান্ডো অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধারা; অপরটি হচ্ছে জনগণের বাকি অংশ অর্থাৎ মোটিভেশনাল আর্মি। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য হাসিমুখে প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। কিন্তু এ সবই বিফল হবে, যদি জনগণ প্রস্তুত না হয়। আর এই প্রস্তুতির জন্যই চাই মোটিভেশনাল আর্মি।
মোটিভেশনাল আর্মি কারা, এবং তাদের ঠিক কি কি করতে হবে? মোটিভেশনাল আর্মিকে বলা যায় প্রস্তুতি বাহিনী। তাদের মোটামুটি কাজ হলো জনগণকে প্রস্তুত করা। এই প্রস্তুতি বাহিনী গঠন করতে হবে আমাদের মধ্যে থেকেই। এতে আপনিও আছেন, আমিও আছি, সমগ্র বাংলাদেশ আছে। মোটিভেশনাল আর্মি তৈরী করা, এবং তার কার্যপদ্ধতির কিছু কিছু অংশ এখানে দেওয়া হলো। এগুলির মধ্যে আপনি যা যা করতে পারবেন সেগুলি করতে আরম্ভ করুন।
মোটিভেশনাল আর্মি বা প্রস্তুতি বাহিনীর গোড়াপত্তন হবে তাদের দ্বারাই যারা ব্যক্তিগত জীবনে সৎ ও আদর্শবাদী হবে, এবং হাজার বিপদেও ভেঙে পড়বেনা। প্রস্তুতি বাহিনীর মনোবল খুবই বেশী হওয়া আবশ্যক, কারণ তারাই সাধারণ লোকেদের সাহস জোগাবে। প্রস্তুতি বাহিনীর প্রশাসন সম্বন্ধেও জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, যেহেতু অনেক সময়েই হয়তো তাদের ওপর প্রশাসনের দায়িত্ব পড়বে। তাদের হতে হবে কষ্টসহিষ্ণু, এবং জনগণের সঙ্গে মিলে যাবার গুণ থাকা দরকার। সর্বোপরি, তাদের থাকবে চারিত্রিক দৃঢ়তা, সেবাপরায়ণতা, এবং সাবধানতা ও গোপনীয়তা অবলম্বন করার ক্ষমতা।
এই প্রস্তুতি বাহিনীর সামনে তিনটি দায়িত্ব রয়েছে। প্রথমতঃ প্রস্তুতি, দ্বিতীয়তঃ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা, এবং তৃতীয়তঃ সংযোগ ও সংবাদ সরবরাহ করা। প্রথম জনপ্রস্তুতি সম্বন্ধে আলোচনা করা যাক।
জনপ্রস্তুতি বলতে আর কিছুই নয়, মুক্তিযুদ্ধের গুরুত্ব ও দায়িত্ব সম্বন্ধে জনগণকে ওকীবহাল করে তোলা। তাদের বোঝানো যে এ লড়াই তাদেরই মুক্তির লড়াই। মুক্তি যোদ্ধাদের সাফল্য হবে জনগণেরই সাফল্য। তাই বাংলাদেশের একমাত্র উপায় হলো মুক্তি সংগ্রামীদের সর্বপ্রকারে সহায়তা করা। তাছাড়া জনগণের দেশপ্রেম জাগিয়ে তুলতে হবে। তাদের জানাতে হবে যে তারা শুধু স্বাধীন বাংলার আশা করবে তাই নয়, তারা সোনার বাংলা তৈরী করবে। বিগত ২৪ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে তাদের বোঝাতে হবে কীভাবে পশ্চিম পাকিস্থানী প্রভুরা বাংলাদেশে একটানা অত্যাচার চালিয়েছে। এবং বিশ্বের অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের ফলে কীভাবে অত্যাচারী শাসকদের পতন হয়েছে তাও জনসাধারণকে জানাতে হবে; বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশেও সেইভাবে অত্যাচারী শাসকের পতন ঘটতে চলেছে।
এসব কাজ করার জন্য গ্রামে ও শহরে প্রস্তুতি বাহিনী তৈরী করা আবশ্যক। এ দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালীর। আপনিও এগিয়ে আসুন। প্রথমে আপনার প্রতিবেশীকে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভ সম্বন্ধে বোঝান। পরে আস্তে আস্তে সমস্ত অঞ্চলবাসীকেই বুঝিয়ে দলে আনুন। দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, বিগত শোষণের ইতিহাস, পাকসৈন্যের সাম্প্রতিক বর্বরতার কাহিনী এবং তার বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের জয়যাত্রা—ইত্যাদি বলে জনগণের দেশপ্রেম জাগ্রত করুন, পাক জঙ্গীশাহীর উৎখাত আরও দ্রুততর করুন। আর লক্ষ্য রাখুন যে আপনার অঞ্চলের প্রতিটি লোক যেন মুক্তিযোদ্ধাদের যথাসাধ্য সাহায্য করে।
প্রস্তুতি বাহিনীর দ্বিতীয় কাজ হলো মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করা। তার জন্য প্রস্তুতি বাহিনীকে জানতে হবে কোথায় মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেওয়া যেতে পারে, রসদই বা কোথায় পাওয়া যাবে, এবং কোন পথে নিরাপদে চলাফেরা করা যায়, ইত্যাদি।
এ প্রসঙ্গে অনিবার্যভাবেই এসে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের তৃতীয় দায়িত্ব, অর্থাৎ সংযোগ ও সংবাদ সরবরাহের কথা। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং এর ওপরেই মুক্তিফৌজের জয় নির্ভর করবে। এ কাজটি হলো নানা জায়গায় যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করা, শত্রুসৈন্য সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের তা দেওয়া, এবং মুক্তি ফৌজের গুরুত্বপূর্ণ বিজয় বার্ত্তাগুলো জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
এসব ছাড়াও প্রশাসন চালানো, আহতদের সেবা শুশ্রূষা, অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ, ইত্যাদি সম্বন্ধে প্রস্তুতি বাহিনীর সুস্পষ্ট ধারণা থাকা আবশ্যক, এবং প্রয়োজন হলেই প্রস্তুতি বাহিনীকে এসব করতে হবে।
আবার জানাচ্ছি, প্রস্তুতি বাহিনীর মনোবল হওয়া উচিত অত্যন্ত দৃঢ়। যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি থাকেই, কাজেই তাৎক্ষণিক জয়-পরাজয়ে প্রস্তুতি বাহিনী বিচলিত হবে না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত, তারা জনগণকে বোঝাবে যে সত্যের জয়, ন্যায়ের জয়, মুক্তিযুদ্ধের জয় অবশ্যম্ভাবী।
মনে রাখবেন, আপনার স্বাধীনতা আনবার জন্য মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধ করছে, হাসিমুখে জীবনদান করছে। তাদের সাহায্যের জন্য আপনার কর্তব্য হলো প্রস্তুতি বাহিনী তৈরী করা। সোনার বাংলার সোনার বাঙালী হতে গেলে আপনার এই কর্তব্যের কথা ভুলবেন না।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল