You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.05 | ওঁরা অমর —মিন্টু বসু | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১

ওঁরা অমর
—মিন্টু বসু

আমার জননী জন্মভূমি সোনার বাংলার দিকে যখন দু’চোখ মেলে তাকাই তখন ভেসে ওঠে এক ভয়াল ভয়ঙ্কর করুণ স্মৃতি। আমার ক্রন্দসী মা’র অশ্রুসাগরে শুধু দেখতে পাই কচুরীপানার মত ভেসে চলছে অসংখ্য জীবন। আমার নিষ্পেষিত বাংলার দিগন্তে তাকালে দেখতে পাই একটা কালো মেঘ। আর তার পাশ দিয়ে যেন বয়ে চলছে একটা রক্তস্রোত! যেন একটা মহাসাগর!
কি ভয়ঙ্কর রূপ! কি উন্মত্ততা! উত্তাল তরঙ্গায়িত ঢেউ আছড়ে পড়ছে সর্বক্ষণ কিসের এক জিঘাংসায়। একটা প্রচন্ড শক্তি যেন উল্কার মত ছুটে আসছে ধ্বংসের উন্মাদনায়।
আমরা দিগন্তের ঐ কালো মেঘকে জানি। ও শুধু একখন্ড কালো মেঘ নয়। ও হোল কালবৈশাখীর কালো মেঘ। ও হোল সাড়ে সাত কোটি জীবনের পুঞ্জীভূত আক্রোশ।
আর ঐ যে রক্তসাগর, ওকেও আমরা জানি। বাংলার লাখো লাখো সন্তানের রক্ত। ওখানে আমার মায়ের রক্ত আছে, বাবার রক্ত আছে। বোনের রক্ত আছে, ভাইয়ের রক্ত আছে, অসংখ্য মানুষের রক্তগঙ্গায় দিগন্তের পূর্ব আকাশ আজ রাঙা হয়েছে, ধূলার ধরণী সিক্ত হয়ে আজ সে রক্তস্রোত এগিয়ে চলেছে পূর্ব দিগন্তে, আর তার মধ্যে থেকেই একটা নূতন সূর্য উদিত হয়েছে, স্বাধীনতার সূর্য।
তাইতো ঐ রক্ত সাগর নীরব নয়, নীরব রক্ত সাগর আজ বিদ্রোহ করেছে। লাখো লাখো মানুষের রক্ত প্রতিশোধ নিতে চাইছে, তাই ঐ রক্ত সাগর আজ বিক্ষুব্ধ!
বিক্ষুব্ধ রক্ত সাগর থেকে জন্ম নিচ্ছে লাখো লাখো বিক্ষুব্ধ সন্তান, বীর সন্তান, সংগ্রামী সন্তান, বিপ্লবী সন্তান, ওঁরা বাংলা মায়ের সন্তান, বাংলা মা ওঁদের নাম দিয়েছেন মুক্তি যোদ্ধা, মা তাঁর ছেলেকে দীক্ষা দিয়েছেন, পরাধীনতার শৃঙ্খলে আর আবদ্ধ নয়, তাই আমি শৃঙ্খল ছিঁড়েছি, এবার আমাকে তোমরা রক্ষা কর।
সন্তান মাকে ছুঁয়ে প্রতিজ্ঞা নিয়েছে, হয় মাকে রক্ষা করব না হয় প্রাণ দেব।
প্রাণ দিচ্ছে বাংলা মায়ের অসংখ্য সন্তান, শুধু প্রাণ দিচ্ছে না, প্রাণ নিয়ে প্রাণ দিচ্ছে। বাংলা মায়ের এক একটি অশান্ত সন্তান অসংখ্য প্রাণ নিয়ে প্রাণ দিচ্ছে; বাংলার স্বাধীনতা তথা বাঙালীর মুক্তির জন্য তাঁরা যুদ্ধ কোরবার ব্রত নিয়েছে। মৃত্যু তাঁদেরকে জয় করেছে তাই জীবন আজ তাঁদের কাছে তুচ্ছ, না হলে হাসতে হাসতে কেউ এমন করে মৃত্যুর সঙ্গে ‍যুদ্ধ করতে পারে!
তাইতো ওঁরা অমর, অক্ষয়, যুগে যুগে ওঁরা পৃথিবীতে আসেন মঙ্গলদীপ হাতে নিয়ে নির্যাতিত নিষ্পেষিত মানুষের পাশে, যেখানে অত্যাচার, বঞ্চনা, শোষণ সেখানেই ওঁরা অস্ত্র হাতে এগিয়ে যান, মুক্ত করেন অত্যাচারের হাত থেকে মানুষকে, রক্ষা করেন জাতিকে।
ওঁদের হাতের দীপ কখনো নেভেনা, জ্বালিয়ে তবে ওঁরা ছুটি নেন। পৃথিবীর ইতিহাস তাই রক্তাক্ষরে ধরে রাখে, জাতি স্বর্ণাক্ষরে লিখে রাখে এই মহাসংগ্রামীদের মহানাম।
পৃথিবীর কালের রথ এগোয়, দিনের পর রাত, রাতের পর দিন আসে ঘুরে ঘুরে। সময় এগিয়ে যায় মহাকালের দিকে—ইতিহাসের পাতা উল্টে যায়, কিন্তু ওঁদের নাম মুছে যায়না কালের বুক থেকে, ওঁরা জাতির ইতিহাসের পাতায় উজ্জল হয়ে থাকেন। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে ওঁরা মঙ্গলদীপ নিয়ে জাতির দিগন্তে দেখা দেন।
ঝিনুক যেমন মুক্তাকে ধরে রাখে বুকে করে তেমনি স্বাধীনতা সংগ্রামীরাও স্বাধীন দেশের স্বাধীন জনগণের বুকে জড়িয়ে থাকেন।
সন্ধ্যা তারা যেমন কালো আকাশের বুকে টিম টিম করে জ্বলে তেমনি বাংলার মুক্তি যোদ্ধারা বাংলার আকাশে টিম টিম করে জ্বলবে।
কাল এগিয়ে যাবে কালের আহ্বানে, কালের রথ থামেনা, সে থামবার নয়, পৃথিবীর দৈনন্দিনের সংবাদ নিয়ে সে আপন মনে এগিয়ে চলে, সাথে সাথে এগিয়ে চলি আমরা। আমরা কালের গহ্বরে হারিয়ে যাব, নতুন আবার স্থান করে নেবে আমাদের স্থানে, কিন্তু নতুন যুগের নতুন মানুষরাও ভুলে যাবেনা আজকের মহাসংগ্রামীদের মহানাম। আমাদের মত ওরাও খুঁজে নেবে কালো আকাশের বুকের অসংখ্য আলোর মাঝ থেকে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদেরকে। নীল আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে ওরাও প্রণাম করবে বিংশ শতাব্দীর যুগের মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত অসংখ্য মহাবিপ্লবীর মহাস্মৃতিতে।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল