বিপ্লবী বাংলাদেশ
৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১
মুক্তি যোদ্ধার ডায়রী থেকে
—আবু আল আজাদ (কানু)
চট্টগ্রামের সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে দেখছি, অদূরে নোঙর করে আছে পরপর কয়েকখানা জাহাজ। উদ্ধত মাথা নিয়ে। কয়েক দিন আগে ঐ জাহাজে করেই জঙ্গী ইয়াহিয়া অস্ত্র পাঠিয়েছে বাংলার মুক্তি যুদ্ধকে নিশ্চিহ্ন করতে। সে অস্ত্র পেয়ে পাক হানাদার বর্বর বাহিনী পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছিল।
আজ তার প্রতিশোধের পালা!
জাহাজগুলোর অবস্থান ভাল করে লক্ষ্য করে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। আমার আর দু’জন সঙ্গী আগেই নৌকায় উঠে বসেছিল। এবার আমি নৌকায় উঠতেই নৌকা ছেড়ে দিল। নৌকার মাঝখানে বসে আমি, সঙ্গী মুক্তিযোদ্ধা দু’জন দাঁড় টেনে চলছে।
মনেমনে আর একবার আমার কর্মসূচী ঠিক করে নিলাম। নৌকাটা এসে থামল নির্দিষ্ট স্থানে, সেখানে থেমেছে তার অদূরেই বিরাট একটি জাহাজ। ঐ জাহাজটাকেই আমার ধ্বংস করতে হবে।
নির্দেশমত ততক্ষণে আমার বন্ধুরা নৌকা থেকে জাল ফেলতে শুরু করেছে। ইলিশ মাছ ধরার জাল। ইলিশ ধরার তো নয়, পশ্চিমা শক্তিকে ধ্বংস করার জাল বিস্তার করে চলছে বন্ধুরা।
ততক্ষণে জাল ফেলা শেষ হয়েছে, এবার আমার কাজ। পায়ের কাছে হাতুড়িটা পড়ে ছিল সেটাকে তুলে নিয়ে নৌকার গলুইতে জোরে আঘাত করলাম। নৌকার গলুইর একটা কাঠ খন্ড খন্ড হয়ে গেল। দেখতে দেখতে নৌকায় পানি উঠে ভরে গেল। তলিয়ে যেতে খুব বেশীক্ষণ লাগলনা।
চট্টগ্রামের উত্তাল তরঙ্গায়িত সমুদ্র বক্ষে তিন বিপ্লবী হাবুডুবু খেতে শুরু কোরলাম। নির্দেশমত আমার বন্ধু দু’জন সাঁতরে চলে গেল আমার দৃষ্টির বাইরে। এবার মহাসমুদ্রের মাঝে আমি একা। ইচ্ছাকৃত হাবুডুবু খেতে খেতে লক্ষ্য করলাম অদূরের জাহাজের খান সৈন্যরা আমাকে উদ্ধার করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
কোনরকমে হাবুডুবু খেতে খেতে জাহাজটাকে গিয়ে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গে উপর থেকে তুলে নেবার জন্য একটি রশি নেমে এল। রশি ধরে উপরে উঠে গেলাম। উপরে উঠতেই সামনে দাঁড়ান দেখলাম কয়েকজন পাঞ্জাবী সৈন্যকে। এতক্ষণের সমস্ত ক্লান্তি মুহূর্তে দূর হোল। সমস্ত শরীর আমার উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে শুরু করল।
আমার উপর এক মহান দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে; প্রাণের বিনিময়েও তা সমাধান করতে হবে।
খানসৈন্যরা আমার জন্য একটা শুকনো কাপড় আর কিছু খাবার নিয়ে এল। ওদের যাতে কোন রকম সন্দেহ না হয় তারজন্য খেতে শুরু করলাম। খেতে খেতে আমার মনে হোল, আমি যেন কতগুলো বিষাক্ত খাদ্য গলাধঃকরণ করে যাচ্ছি।
তবু উপায় নেই, না খেলে কোন রকম সন্দেহ হতে পারে। আমাকে খেতে দেখে পাক সৈন্যরা একটু দূরে সরে গেল। ওদের এই সরে যাওয়ার সুযোগে নিজেকে প্রস্তুত করে নিলাম। বুকের সঙ্গে বাঁধা মাইনটা খুলে নিলাম। ছোট্ট একটি অস্ত্র অথচ কি প্রচন্ড তার শক্তি! এর পর নির্দেশমত মাইনটাকে ফেলে দিলাম জাহাজের নীচে। পনেরো মিনিট সময়। তারপরই ধ্বংস হয়ে যাবে পাক অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্য বোঝাই জাহাজটি।
কিন্তু তার আগেই আমাকে নেমে পড়তে হবে জাহাজ থেকে। আমার খাওয়া শেষ হয়েছে মনে করে খান সেনারা এগিয়ে এল। ওদের আসতে দেখেই উঠে দাঁড়ালাম। আমাকে উঠতে দেখে ওরা বোধহয় আশ্চর্য হোল।
ওদেরকে বুঝিয়ে বললাম যে, আমার দু’জন সঙ্গীকে স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, তাদেরকে আমার খুঁজতে হবে। এবার আমাকে যেতে হবে।
শত অনুরোধেও ওরা আমাকে ছাড়তে চাইল না, কি জানি এর পিছনেও কোন অভিসন্ধি আছে কিনা?
সময়ও নেই, পাঁচমিনিট হয়ে গেছে, কি করি এখন? ভাবতে ভাবতে আরো পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হোল। সমস্ত শরীর আমার ঘামতে শুরু করেছে। যাহোক একটা কিছু করতেই হবে।
আর অপেক্ষা নয়, তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু। উপায়ান্তর না দেখে ওদেরকে কোন রকম সুযোগ না দিয়েই লাফিয়ে পড়লাম অশান্ত সমুদ্রে, মুহূর্ত মাত্র। তারপরই বিকট শব্দ! পিছনে তাকিয়ে দেখলাম দৈত্যর মত জাহাজটা জলের নীচে ধীরে ধীরে নিমজ্জিত হচ্ছে, সমস্ত জাহাজটা ধ্বংস হয়ে গেছে।
প্রতিশোধ! অনেক রক্তের প্রতিশোধ! উত্তাল তরঙ্গায়িত সমুদ্রের বুকে সাঁতরে চললাম—সাঁতরে চলেছি অথচ মনে হচ্ছে সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন আমাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল