বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৯ আগস্ট ১৯৭১
মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব
বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর কিছুদিন সকলেই সন্দিগ্ধ ছিলেন। সবারই সন্দেহ ছিল যে একটা জাতি, তা সে যত বড়ই হোক না কেন, একটা সুসংঘবদ্ধ সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে পারবে কি? কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধাদের জয় ততোই সুনিশ্চিত হয়ে উঠছে। দিকে দিকে গড়ে উঠছে আঞ্চলিক প্রতিরোধ বাহিনী, গেরিলাযুদ্ধ জোরদার হচ্ছে, ফলে সৃষ্টি হচ্ছে মুক্তঅঞ্চল। পাকসৈন্য খতম করাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ও সহজ হয়ে যাচ্ছে। আর, ব্যাপার ঘোরালো দেখে ‘ইয়া আল্লা খান (ইয়াহিয়া) ‘মোলায়েম’ খান (মোনেম খান), এবং ‘টিকিয়া কাবাব’ খান (টিক্কা) এখন নিজের নিজের প্রাণ বাঁচানোই বেশী দরকার বলে মনে করছেন।
অবস্থা এরকম হওয়াটা অবশ্য খুব সহজে বা রাতারাতি হয়নি। পাকসৈন্যকে এভাবে কাবু করতে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচুর কষ্ট স্বীকার করতে হয়েছে। তাঁরা আত্মীয়-পরিজন, ভিটে মাটি সব ছেড়ে দিনের পর দিন, রাতের পর রাত গেরিলা ট্রেনিং নিয়েছেন। সৈনিকদের যেখানে প্রচুর খাদ্য প্রয়োজন, সেখানে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় অর্ধাহারে দিন কাটিয়েছেন। কাপড়-জামা, অস্ত্রশস্ত্র ইত্যাদি সবই পরিমাণে কম, তবু তারই সুদক্ষ ব্যবহারে ও অটুট মনোবলের জোরে তাঁরা পাকসৈন্য ঘায়েল করেছেন, দখল করেছেন পাকসৈন্যের অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ। তারপর আবার সেগুলি দিয়েই চলছে পাকসৈন্য নিধন। এগিয়ে আসছে স্বাধীনতার দিন।
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা এভাবে রক্ত দিয়ে, প্রাণ দিয়ে যে স্বাধীনতা আনছেন তা শুধু তাঁদের নয়। তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, প্রতিটি বাঙালীর স্বাধীনতা। কাজেই, এ লড়াই প্রতিটি বাঙালীর লড়াই। এ মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব সকলেরই ঘাড়ে নিতে হবে। দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে আজ অবধি কোনো জাতি স্বাধীনতা পায়নি। বাংলাদেশ স্বাধীন করার বিরাট সুযোগ আজ বাঙালীর হাতে এসেছে। এ সুযোগ নষ্ট করা যায় না। তাই আজ বাংলার ঘরে ঘরে যত ভাই বোন আছেন, সকলকেই মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব নিতে হবে।
একথা ঠিক যে, সকলকেই বন্দুক ঘাড়ে লড়াই করতে হবে তা নয়। কিন্তু বন্দুক ঘাড়ে লড়াই করা ছাড়াও অন্যান্য বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। সেগুলি সম্বন্ধে প্রতিটি বাঙালীর জানা প্রয়োজন। নীচে তার কয়েকটি দেওয়া হলো :-
(১) মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে সম্পূর্ণ সহযোগিতা—মুক্তিযোদ্ধাদের যা যা প্রয়োজন সেগুলো যথাসাধ্য মিটিয়ে দিন। তাদের আশ্রয়-খাদ্য দিন, পাকসৈন্যের সংখ্যা এবং গতিবিধি সম্বন্ধে মুক্তিফৌজকে তথ্য জোগাড় করে দিন, মুক্তিফৌজ যাতে নিরাপদে চলতে পারে তার ব্যবস্থা করুন।
(২) পাকসৈন্যদের সঙ্গে সম্পূর্ণ অসহযোগিতা—লক্ষ্য রাখুন পাকসৈন্য যেন কোথাও আশ্রয়-রসদ ইত্যাদি না পায়। মুক্তিফৌজ সম্বন্ধে পাকসৈন্য কিছু জানতে চাইলে একেবারে ভুল খবর দিন। প্রাণপণে চেষ্টা করুন পাকসৈন্যরা যেন কোন সুযোগ-সুবিধা না পায়।
(৩) অন্তর্ঘাতমূলক ব্যবস্থা—পাকসৈন্য যাতে আটকা পড়ে বা সহজে চলাফেরা করতে না পারে সেজন্য যে যে সড়ক ও সেতু অবরোধ বা ধ্বংস করা দরকার, তাদে সহায়তা করুন। পাকসৈন্যের আশ্রয়স্থল ধ্বংস করুন, তাদের যে উপায়ে সম্ভব অসুবিধায় ফেলুন। এসব কাজে মুক্তিফৌজকে আপনাদের সহায়তা করবে।
(৪) আঞ্চলিক প্রতিরোধ বাহিনী—প্রতিটি অঞ্চলে গড়ে তুলুন আঞ্চলিক প্রতিরোধ বাহিনী। এই বাহিনী দিয়ে অন্তর্ঘাত ও প্রতিরোধ চালিয়ে যান। যে যে অঞ্চলে প্রতিরোধ বাহিনী আছে, সেগুলি আরো শক্তিশালী করুন।
(৫) জনসংযোগ ও প্রচারণা—বাংলার ঘরে ঘরে মুক্তিফৌজের বিজয়বার্তা পৌঁছে দিন। বাঙালী যে ভীরু কাপুরুষ নয়, তারা যে লড়াই করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে পারে তা সবাইকে জানিয়ে দিন। মুক্তিফৌজ যেভাবে মরণপণ সংগ্রামের দ্বারা জয়ের দিকে এগোচ্ছে, তার খবর আপনারা নিয়মিতভাবে এই পত্রিকায় পাবেন।
(৬) প্রহরা—সর্বদা নজর রাখুন কোনো ঘৃণ্য শত্রু স্বাধীনতা লাভের পথে বাধা দিচ্ছে কিনা। এ সম্পর্কে কোনো তথ্য পেলেই তা মুক্তিফৌজকে জানান, অথবা নিজেরাই তাকে খতম করুন। যত প্রিয় বা পরিচিতই হোক না কেন তাকে বাঁচিয়ে রাখা চলবে না। রাজাকারদের ও পাক গুপ্তচরদের প্রতি সতর্ক থাকবেন।
মনে রাখবেন, বাংলার স্বাধীনতা বাঙালীই আনবে। কাজেই একজন বাঙালী হিসেবে আপনার কর্ত্তব্যের কথা ভুলবেন না। উপরের নির্দেশগুলি মনে রাখবেন এবং প্রয়োজনমতো আরও যা দরকার তা করে যাবেন। মুক্তিযোদ্ধারা বাংলার স্বাধীনতার জন্য রক্ত দিচ্ছে, প্রাণ দিচ্ছে, জয়লাভ করছে। তাদের ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রাখুন, সহায়তা করুন। বিনিময়ে তারা আপনাকে দেবে স্বাধীন বাংলা।
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল