বিপ্লবী বাংলাদেশ
২৯ আগস্ট ১৯৭১
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ
দিলীপ কুমার দাস
আজ থেকে দীর্ঘ ২৪ বছর পূর্বে অখন্ডিত ভারত দ্বিধা বিভক্ত হয়ে ভারত ও পাকিস্তান এই দু-ভাগে বিভক্ত হয়েছে। জন্ম লগ্ন থেকেই পাকিস্তান নিজেকে ক্ষুদ্রত্বের গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ করে রেখেছে—ইসলামিক রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের জনসংখ্যার সংখ্যাগুরু অংশ হল পূর্ববাংলা, বর্ত্তমানে স্বাধীন বাংলাদেশ। যদিও পাকিস্তানের শাসক হিসেবে সংখ্যালঘু পশ্চিম পাকিস্তানের জনতারাই সব রকমের সুযোগ সুবিধা যথেচ্ছ ভোগ করে আসছিল। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ইতিহাস হল শোষণের ইতিহাস—মাত্র ২৩টি পরিবার সমস্ত পাকিস্তানের ধন ঐশ্বর্য্য ইচ্ছেমত লুণ্ঠন করে নিজেদের পূঁজি বাড়িয়েছে এবং বাংলাদেশকে করেছে অবাধলুণ্ঠনের পীঠস্থান। যে পাকিস্তানের সমস্ত অর্থনৈতিক কাঠামোটা পুরোপুরি ভাবে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে, সেই বাংলাদেশকে বাদ দিলে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামোর কোন অস্তিত্বই তার অবশিষ্ট থাকে না। গোটা পাকিস্তানের সমস্ত বৈদেশিক আয়ের শতকরা ৭৫ ভাগ আয় হয় পূর্ব বাংলার সম্পদ থেকে অথচ এ দেশের উন্নতি কল্পে ১০ ভাগের বেশি অর্থ ব্যয় করা হয় না। পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের শুরুতেই হিন্দু ও মুসলমান এই দ্বি-জাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি হিন্দু মুসলমান ধর্মীয় গোঁড়ামির উপর প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানকে কোনদিনই মনে প্রাণে গ্রহণ করতে পারেনি; আর পারেনি বলেই পশ্চিম পাকিস্তানী কসাইয়ের দল বার বার একদল দুষ্কৃতিকারী এবং সাম্প্রতিক নেতার প্ররোচনায় সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা সৃষ্টি করে হিন্দু মুসলমানের বিবাদ জিইয়ে রেখেছে। মুসলিম লীগের নেতারা প্রত্যক্ষ ভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং গোলযোগের সৃষ্টির সাথে যুক্ত ছিল। মুসলীম লীগ ও তার সাগ্রেদ দালালের দল আজো বাংলার হাজার হাজার মা বোনের উপর অত্যাচার ও উৎপীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে।
আপাতত দৃষ্টিতে ১৪ই আগস্ট বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষের কাছে এক সুখকর স্বপ্নের স্মৃতি বহন করে আনে কারণ এই দিনটিতে আমরা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণের হাত থেকে মুক্ত হবার পবিত্র মন্ত্র উচ্চারণ করে থাকি। অথচ যদি একটু গভীরে প্রবেশ করে অনুধাবন করি তা হলে দেখা যাবে আমাদের এই ধারণা এই মিথ্যে কুহেলিকায় আচ্ছন্ন। আজ দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতায় সাড়ে সাত কোটি বাঙালী বুঝতে পেরেছে স্বাধীনতার নামে একটি পরাধীন দেশ দারিদ্র্য, হতাশা, নিরাশা, শোষণ ও নিষ্পেষনে জর্জরিত।
সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ বাঙালীরা কি পেয়েছে? এক কথায় এর জবাব দেয়া যায় না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত হলেও মৌলিক স্বাধীনতা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ পায়নি—সে স্বাধীনতা পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বল্প সংখ্যক শোষকের দল। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্ত হবার সংগ্রামে যে বাঙালীদের অবদান সবচেয়ে বেশি আজ তারা পশ্চিমী হায়নাদের নূতন উপনিবেশে পর্যবসিত হয়েছে। যখনই মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদের পা-চাটা কুকুরের দল ব্যক্তিগত স্বার্থ সিদ্ধির পথে বাধার সম্মুখীন হয়েছে তখনই পাকিস্তানের বুকে, বিশেষ করে বাংলা দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে দেশময় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে জন-জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। মুসলীম লীগ ও তার অনুগামীদের এই জঘন্য খেলা বেশি দিন বাংলা দেশে নির্বিবাদে চলতে পারলো না, সচেতন বাংলার জাগ্রত যুব সমাজ এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। ঢাকা রাজধানীর বুকে হিন্দু ভাইকে বাঁচাতে গিয়ে মুসলিম বাঙালী ভাই প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, এ নজির অনেক পাওয়া যায়। বাংলার পিছনের ইতিহাস আলোচনা করলে বর্ত্তমান স্বাধীন বাংলার আত্মপ্রকাশের সঠিক স্তরগুলো আমরা বুঝতে পারব।
১৯৪৭ সালের পাকিস্তান সৃষ্টির অল্প পরেই পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ বিরোধী গণতান্ত্রিক দলগুলোর রাজনৈতিক আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। এই সব লীগ বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের প্রয়াস প্রথম দিকে গণ-আন্দোলনে রূপান্তরিত হতে পারেনি। দীর্ঘ সময়ে পদ্মা মেঘনা, ধলেশ্বরী, বুড়িগঙ্গা ও কপোতাক্ষের অনেক জল প্রবাহিত হয়ে গেছে—জাগ্রত বাংলার ঐতিহ্যবাহী জনসাধারণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিশেষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে।
বিরোধী দলগুলোর এই রাজনৈতিক আন্দোলন সুষ্ঠু-ভাবে গড়ে তোলার কৃতিত্বের গৌরব যাঁরা দাবী করতে পারেন তারা হলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানি, হোসেন শহীদ সারোয়ার্দি ও বাংলার নয়ন মণি শেখ মুজিবর রহমান। ইংরেজি ১৯৪৯ সালে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের ন্যায় পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে দেখা দিল একটি নূতন নক্ষত্র—যার নাম হল আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ শব্দটির অন্তর্নিহিত অর্থটি অত্যন্ত অর্থবাহী। মুসলিম ধর্মগ্রন্থ থেকে এর মর্মার্থ গ্রহণ করা হয়েছে’—“লিল্লাহে মাফুস সামাওয়াত ওয়া মফিলার্দ—”এই পৃথিবীর যে সব বস্তু আমাদের দৃষ্টি গোচর হয় তার সমস্তই সর্বশক্তিমান আল্লাহর। এই তাৎপর্য পূর্ণ কথার মধ্যে নিহিত আছে মানুষের মৌলিক অধিকার ও স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠার সাথে সাথে মুসলিম লীগের মৃত্যুঘন্টা পাকিস্তানের চতুর্দিকে ধ্বনিত হল। পাকিস্তানের স্বেচ্ছাচারি শাসকবর্গ বুঝতে পারল আর বেশিদিন বাংলা দেশকে আয়ত্তের মধ্যে রাখা যাবে না। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গ নিজেদের শোষণ ব্যবস্থা বাংলার বুকে কায়েম করার স্থায়ী ব্যবস্থা হিসেবে প্রথম পদক্ষেপ নিল। বাংলার জনসাধারণের মুখে ভাষা ‘বাংলা ভাষাকে’ কেড়ে নিয়ে জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেবার হীন ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে। বাংলার যুব সমাজ, ছাত্র ও শিক্ষক নির্বিবাদে এই অবিচার মেনে নিতে পারল না, বিদ্রোহী বাঙালীরা এর বিরুদ্ধে গর্জে উঠল—শপথ নিল রক্ত দেব তবু মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে দেব না। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্র ভাষা ‘বাংলা’র দাবীতে যুবশক্তি প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল—ঢাকার রাজপথ আসলাম, বরকত, জব্বার এবং আরো অনেক তরুণ শহীদদের বুকের তাজা রক্তে লাল হয়ে উঠল। শহীদের রক্ত দান কোনদিন ব্যর্থ হয়না—জীবনের বিনিময়ে মাতৃভাষার স্বীকৃতি বাংলার সন্তানেরা আদায় করে নিয়েছে। ১৯৫০ সনের সর্বনাশা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে পাক সরকার চেয়েছিল বাংলা দেশের জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনার প্রসারকে স্তব্ধ করে দিতে কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হল না—উপরন্তু জনসাধারণের মধ্যে নূতন চেতনার উন্মেষ হল, অগ্রগামী রাজনৈতিক কর্মীরা সাম্প্রদায়িকতা দূর করার জন্য একান্ত ভাবে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন। আওয়ামী লীগ কর্মীদের বলিষ্ঠ প্রচারের মাধ্যমে বাংলা দেশের জনসাধারণ নিজেদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে বিশেষ ভাবে সচেতন হয়ে উঠল। ১৯৫৪ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ফজলুল হক, মওলানা ভাসানি ও তরুণ নেতা শেখ মুজিবর রহমানের যোগ্যতম নেতৃত্বে তদানীন্তন যুক্তফ্রন্ট দল বিপুল সংখ্যক আসনে জয়লাভ করে পূর্ব বাংলা থেকে সাম্প্রদায়িক দল মুসলিম লীগের অস্তিত্ব চিরতরে মুছে দিলেন। স্বায়ত্ত শাসন সহ একুশ দফা দাবীর ভিত্তিতে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু এই সরকারকে বেশী দিন বেঁচে থাকতে দিল না পাক কেন্দ্রীয় সরকার—৯২(ক) ধারা প্রয়োগ করে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিল। ফজলুল হককে হিন্দুস্তানের (ভারতের ) দালাল বলে নিজ গৃহে অন্তরীণ রাখা হল। তারপর ১৯৫৬ সালে বাংলা দেশে জনাব আতাউর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত হল দ্বিতীয় আওয়ামী লীগ সরকার। কিন্তু এই সরকারকেও বেশী দিন চলতে দেওয়া হল না। ১৯৫৮ সালে জেনারেল আয়ুব খান গণতন্ত্রের টুঁটি চেপে হত্যা করে নিজের হাতে সমস্ত ক্ষমতা গ্রহণ করল। তারপর একটানা দশ বছরের উপর আয়ুব খানের বর্বর একনায়ক জঙ্গী শাসন চলল। রাজনৈতিক দিক থেকেও এই দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে বাংলা দেশের বুকে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্রে মিথ্যে মামলায় শেখ সাহেবকে জড়িয়ে, কারারুদ্ধ করা হল। দীর্ঘদিন বিনা বিচারে তাঁকে কারারুদ্ধ করে রাখা হল এমনকি গুপ্তঘাতকের দ্বারা শেখ সাহেবকে হত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করা হল কিন্তু তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। আয়ুবের সামরিক শাসনের বর্বর অত্যাচারে বালুচ, পাঠান এবং বাঙালীদের মধ্যেই বিক্ষোভের সৃষ্টি হয় বেশী। ১৯৬৮ সালের মাঝামাঝি তথাকথিত ‘বুনিয়াদী গণতন্ত্র’ মার্কা সাধারণ নির্বাচনের ভন্ডামি করা হয়। এই নির্বাচনে এগার কোটি পাকিস্তানির মধ্যে মাত্র এক লক্ষ বিশ হাজার লোকের কপালে ভোটদানের সুযোগ জুটল। বাংলার জনসাধারণ এই স্বৈরাচার মুখ বুজে সহ্য করল না। ‘নির্বাচন বয়কট কর’—এই সোচ্চার আওয়াজের মধ্যে এক তীব্র আন্দোলন দাবানলের মত জ্বলে উঠল। গোটা পাকিস্তান জুড়ে আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গে আয়ুব খান দিশেহারা হয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে নেপথ্যে সরে যেতে বাধ্য হল। (ক্রমশঃ)
সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল