You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.04 | বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন | বিপ্লবী বাংলাদেশ - সংগ্রামের নোটবুক

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৪ আগস্ট ১৯৭১

বিশ্ববিবেকের কাছে আবেদন

আপনারা এগিয়ে আসুন বিপন্ন মানবতাকে সাহায্য করবার জন্য! পৃথিবীর পূর্বদিগন্তে গণতন্ত্রের জাগ্রত চেতনাকে রক্ষা করুন। স্বাধীনতাকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবন সূর্যকে বাঁচতে দিন। বিংশশতাব্দীর কলংকিত জল্লাদের কারাগারে থেকে মুক্ত করুন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খাঁ বাংলা দেশের জনসাধারণ এবং গণতন্ত্রর প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে গ্রেপ্তার করেছে শেখ মুজিবরকে। দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে সামরিক আদালতে গোপন বিচার নামক প্রহসনের দ্বারা মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করবার স্পর্দ্ধা ঘোষণা করেছে বিশ্বের কোটী কোটী ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠ মানুষের সামনে।
প্রশ্ন জাগে—বিশ্বাস ঘাতক কে? শেখ সাহেব না ক্ষমতার দম্ভে পশুর মত উন্মাদ হয়ে উঠেছে যে ইয়াহিয়া খাঁ সেই? কে দেশদ্রোহী? জনতার প্রিয় মুজিব—না জনতার ধিক্কৃত শত্রু ইয়াহিয়া খাঁ।
নব ইতিহাসের কুখ্যাত নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া আর তার সাকরেদরা মনে করে তারা বাদশা—তারা সম্রাট, বাংলাদেশের মানুষের উপরে তারা শোষণ শাসন আর পাশবিক অত্যাচারের অধিকারী। তাই ২৪টি বছর ধরে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে তারা ক্রীতহাসের অন্ধকার নরক জীবনে নিয়ে যেতে বসেছিল।
তাদের সেই উপনিবেশবাদী শোষণের বিরুদ্ধে নতুন এক সূর্যের অভ্যুদয় ঘটলো বাংলা দেশে। সেই দেশপ্রেমিক নবীন সূর্য বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিব।
তিনি বিশ্বগণতন্ত্রের একটি অমলিন দীপশিখা। নিপীড়িত মানুষের কাছে তিনি ন্যায় ও আদর্শের মূর্ত প্রতীক।
সাড়ে সাতকোটি মানুষের এই জনগণমন-অধিনায়ক জেনারেল ইয়াখাঁর প্রস্তাবিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ করে দিয়েছেন, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিত্ব কতখানি সুদৃঢ়। বর্তমান দুনিয়ায় কোন একটি রাজনৈতিক দলের সংখ্যা গরিষ্ঠতার এমন নজীর বোধহয় দেখা যায় নি। শেখ মুজিব তাই ইতিহাসের পাতায় একটি সোনালী সংলাপ।
সেই বঙ্গবন্ধু শেখ ‍মুজিবর রহমান আজ বারোলক্ষ বাঙালীর রক্ত-খেকো-পশু, জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে বন্দী।
পৃথিবীর গণতন্ত্রের এ যেন এক নিষ্ঠুর পরীক্ষা। তাই কোটি কোটি মানুষের হৃদয় দুর্ভাবনায় উদ্বেগপূর্ণ দোলায় দুলছে। এ দুর্ভাবনা শুধু বাঙালীর নয়—বাংলাদেশ সরকারের নয়—এই দুর্ভাবনা দেশকালের ভৌগোলিক বেড়া ডিঙিয়ে লক্ষকোটি মানুষের হৃদয়ে।
আজকের অমানুষ এবং কাপুরুষ ইয়াহিয়া—এবং তার পূর্বসূরী জেনারেল আয়ুব খাঁ ও গদীচ্যুত প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা এক সময়ে বহুটাকা ইনাম দিয়ে—যাকে বলে কয়েককোটি টাকা ঘুষ দিয়ে কিনতে চেয়েছিল শেখ সাহেবের সমর্থন। এই ইয়া খাঁও চেয়েছিল নির্বাচনের আগে ও পরে ঢাকায় এসে। কিন্তু ইনামের বশে বাংলাদেশকে কলোনী হিসাবে তার হাতে রাখতে স্বীকৃত হলেন না বঙ্গবন্ধু। আর জঘন্যতম নরকের কীট ইয়াহিয়া খাঁ সাহেবের কাছে এটাই বোধহয় বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় দেশদ্রোহিতা।
জেনারেল ইয়া খাঁ আজ তাই পাগল হয়ে উঠেছে নিজের স্বার্থে; এই ন্যায় ও সত্যের আদর্শে বলীয়ান নেতাকে সামরিক আদালতে একটি প্রসহন বিচার দ্বারা মৃত্যুদন্ডে পথের কাঁটা দূর করবে বলে।
সংগ্রামী জনতা—এবং দুনিয়ার বিবেকবান মানুষের কাছে আজ তাই ইয়াখাঁর চ্যালেঞ্জ। পৃথিবীর দিকে দিকে সকল রাষ্ট্র্র এবং আদর্শের কাছে অস্থিরমতি ক্লীব ইয়াহিয়া আজ বিবেক হত্যার চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে।
পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীর জন্যে সুখ এবং শান্তির বৈজ্ঞানিক নিরীক্ষায়রত রাষ্ট্র নায়কেরা—তাঁরা কি তাদের সদ্‌ইচ্ছার পরিচয় না দিয়ে কাপুরুষ ইয়াখাঁর কাছে বিবেকের বলিদান দেখাবেন। পাগলা কুত্তাকে ডান্ডা মেরে ঠান্ডা করবার রীতি থেকে তারা কি বিরত রাখবেন নিজেদের?
১৯৬১ সালে লুমুম্বা হত্যার যে বেদনাদায়ক ঘটনা বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছিল, আজও কি সেই বেদনাদায়ক ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে চায়—মানুষের কল্যাণ সাধনের নতুন পৃথিবী? সমগ্র পৃথিবীর কাছে তাই আজ চ্যালেঞ্জ রেখেছে জেনারেল ইয়াহিয়া—হয় তার নিষ্ঠুর হত্যালীলার সাক্ষী থাকুক বিশ্ববিবেক, নতুবা মানবতার মূল্য স্বীকৃত হোক, গতিরোধ হোক ফ্যাসীস্ট দস্যু ইয়াহিয়া খাঁর।
কাপুরুষ হত্যাকারী, বারোলক্ষ নরনারীর রক্ত পানকারী ইয়াখাঁর বন্দীশালা থেকে মুক্ত করুন—বিশ্ব বিবেক শেখ মুজিবর রহমানকে। আজকের নরখাদক ইয়াহিয়া এবং তার পূর্বসূরী আয়ুব চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীত্বের ও সম্পদের লোভ দেখিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বাঙালীদের কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে। তারা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধু যেন ছয় দফাকে আপোষ করে প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু এই কাপুরুষের দল মুজিবকে চিনতে ভুল করেছে। ওরা জানে না মুজিব নিজের জীবন দিতে পারে কিন্তু বাংলার গরীব দুঃখী মানুষের দাবী নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে পারেনা। তাই বঙ্গবন্ধু ছয়দফার ব্যাপারে আপোষের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে তার দাবীতে অটল ছিলেন। কারণ তিনি ভালোবেসেছিলেন বাংলার মানুষকে, বাংলার মাটিকে এবং এটাই ছিল ইয়াহিয়াদের কাছে শেখ সাহেবের বড় অপরাধ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের ৬ দফার মাধ্যমে নতুন এক শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থার দাবীতে বিপ্লবের ডাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালী অনুপ্রাণিত হয়ে লাখ লাখ জীবন, রক্তের বিনিময়ে পঁচিশে মার্চ রাতে সৃষ্টি করেছেন পৃথিবীর মানচিত্রে এক গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাঙলা দেশ। সেই বাংলাদেশের তরফ থেকে আপনাদের হাতে এই ‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’ পত্রিকা তুলে দেওয়া হলো।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল