You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
২১ আগস্ট ১৯৭১

বেসামাল ইয়াহিয়া

ইতিহাসের নিকৃষ্টতম মোসাফেক, জঘন্যতম খুনী, মানুষ নামধারী পিশাচ ইয়াহিয়া আজ বেসামাল হয়ে পড়েছে তার নারকীয় পাশবিক ক্রিয়াকান্ডের চরম পরিণতি লক্ষ্য করে। তাই আজ এই বদ্ধ-মাতাল কখন কি বলছে তা সে নিজেও জানেনা। বাঙালী জাতির নয়নমণি জাতির পিতা শেখ মুজিব, যিনি আজীবন সাধনা করেছেন অহিংস, অসহযোগ ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তনে—ধূর্ত ইয়াহিয়া তার বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে হিংসা ও বিপ্লবের। বিশ্ববাসী শেখ সাহেবকে চিনে; জানে। জানে তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবন-দর্শন—তাই ইয়াহিয়ার শত মিথ্যার বেসাতী এই মহান নেতাকে তাদের হৃদয়ের শ্রদ্ধার আসন থেকে এতটুকুও সরাতে পারবেনা। স্বার্থান্বেষী মহল বিবেককে পদাঘাত করে ইয়াহিয়ার সুরে হয়ত কিছু সময়ের জন্য সুর মিলাবে কিন্তু স্বার্থ উদ্ধার হলেই বা স্বার্থ না হওয়ার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র তারাই তাকে আর্বজনার আস্তাকুঁড়ে—বিসর্জন দেবে। মহান নেতা ঐসব স্বার্থান্বেষী মহলের নিকট চিরদিন “মহান” বলেই পরিগণিত হবেন। তারা জানে নর-ঘাতক ইয়াহিয়া মানুষ নামধারী পশু বই অন্য কিছুই নয়।
অনেক বিনিদ্র রজনীর ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতিই চক্রান্তের নায়ক কিসিঙ্গারের চীন গমন ও চীন-আমেরিকার স্বার্থান্ধ সামরিক ও বেসামরিক আশ্বাস। ঐ বলে বলীয়ান ইয়াহিয়া ভারতের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার ছেড়েছে। বিদেশীর পদলেহী ইয়াহিয়া জানে কিভাবে উপরওয়ালাকে খুসী রাখতে হয়। এবং সেই বিদ্যায় পারদর্শিতার সুযোগে কুখ্যাত আয়ুবকে তোষামোদে বিভ্রান্ত করে বহু উপরস্থ সেনাপতি ডিঙ্গিয়ে প্রধান সেনাপতিত্ব বাগিয়ে নিয়েছে। সময়ে বিশ্বাসঘাতক তাঁর মনিবের সিংহাসন দখল করে; যেমন আয়ুব করেছিল একই ব্যবহার মির্জার সঙ্গে। দাসত্ব দিয়েই যার জীবন শুরু; সুরা, নারী ও অর্থই যার জীবনের একমাত্র কাম্য, সেই পর-পদলেহী পরাশ্রিত জীব আজ তাই খুঁজছে নূতন মনিব, যাদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিশ্চিন্ত নির্ভয়ে জীবন কাটাতে পারে। সে তার নূতন মনিবের সন্ধান পেয়েছে চীন ও আমেরিকায় এবং সে কারণেই কাপুরুষ ক্ষমতালোভী আজ ক্ষমতার দম্ভে বেশামাল।
ইয়াহিয়া মহান নেতা শেখ মুজিব এবং তার অনুগামী আওয়ামী লীগ ও সাড়ে-সাত-কোটী বাঙালী জাতিকে বুঝবার ক্ষমতা রাখেনা। তাই সে “বিলাস বহুল ইছলামাবাদ রাজ প্রাসাদে রঙ্গীন নেশায় যে স্বপ্ন দেখেছিল, সে স্বপ্নকে শেখ মুজিবের বাঙালী জাতি ভেঙে চূড়ে চূরমার করে দিয়েছে। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামে বিশ্বাসী জাতির মহান নেতা ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেওয়া পাঞ্জাবী কুত্তাদের হাতে বন্দী হওয়ার পূর্বে জাতিকে বিপ্লবের ডাক দিয়ে যান এবং তারই পরিণতিতে আজ আমরা পাচ্ছি বিপ্লবী বাংলাদেশ সরকার ও তার মুক্তি বাহিনী। ঝড়ের গতিতে আজ গেরিলা যোদ্ধারা বাংলার দিকে দিকে তাদের জয় পতাকা উড়িয়েছে এবং হাজার হাজার খান সেনা তাদের হাতে নিহত হচ্ছে দিনের পর দিন।
মূর্খ-টিক্কার উপর ছেড়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া বাঙালী জাতীর হত্যাযজ্ঞ; কারণ ইয়াহিয়ার আস্থা ছিল যে এই বেইমান বেলুচ ঈদের দিনেও যখন ইদি জমাতে হাজার হাজার বেলুচকে হত্যা করতে পারে, তখন বাঙালীকে সে বাহাত্তর ঘন্টায় শায়েস্তা করে বাংলা দেশকে পাঞ্জাবের পাকাপোক্ত উপনিবেশে পরিণত করতেও সক্ষম হবে। কিন্তু টিক্কা ও পাঞ্জাবী কুত্তার দল তাকে সম্পূর্ণ হতাশ করেছে। খান সেনারাও আজ তাদের রাষ্ট্রপ্রধান “ইমাম ইয়াহিয়ার” পদাঙ্ক অনুসরণ করে আমার দেশের মান-বোনদের ইজ্জৎ নিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সারা বাংলার ব্যাংকগুলো ও “আয়ুবের ইছলামী প্রজাতন্ত্রের” মদের দোকানগুলোও উজার করে রাতারাতি প্রত্যেকেই এক একটা ইয়াহিয়ায় রূপান্তরিত হয়েছে। ইয়াহিয়া প্রাসাদে স্বপ্ন দেখে; আর হোই-হোই ইয়াহিয়ারাও অকস্মাৎ সম্পদের অধিকারী হয়ে যুদ্ধ-ভীতি রোগে ভুগতে শুরু করেছে। চরিত্রহীন নরঘাতক পশুর দল চরিত্র বলে বলীয়ান ও জাতির পিতার আদর্শে একনিষ্ঠ বিশ্বাসী বাঙালী জাতিকে পর্য্যুদস্ত করার ক্ষমতা রাখেনা। বিপ্লবী বাংলা দেশ আজ এক বাস্তব সত্য। এ সত্য মুরব্বী আশ্রিত ইয়াহিয়াও আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। কিন্তু সে নিজের সৃষ্ট দুষ্কর্মের জালে আবদ্ধ। বেরুবার শক্তি ইয়াহিয়ার নেই। ইয়াহিয়াকে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতেই হবে। বাংলা দেশে আজ সে একজন ঘৃণ্য ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। কিন্তু তাই বলে পাঞ্জাবে তথা পশ্চিম পাকিস্তানেও কি সে বাঞ্ছিত ব্যক্তি? মোটেই না।
আসন্ন পরাজয় তাকে পাগল করে দিয়েছে এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গোরাও আজ শুধু অপেক্ষা করছে ঐদিনের, যখন তাদের কেউ গদী লাভ করবে। ক্ষমতা ও লোভে অন্ধ এই নরপশুর দল মুহূর্তের জন্যও ভাবছেনা যে পাকিস্তান রাষ্ট্র আজ ৪/৫ খন্ডে বিভক্ত হয়ে ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। ক্ষমতার লড়াইয়ে শেষ পর্য্যন্ত এদের সবাইকেই সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী গণ-মানুষের হাতে “বলী” হতে হবে। ইয়াহিয়ার বিচার দেখবার সুযোগ জনগণ আমাদেরকে দেবেনা কারণ ইয়াহিয়া তার পূর্বেই জনতার রুদ্ররোষে পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
—মেহেরুল আমিন

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!