You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিপ্লবী বাংলাদেশ
৪ আগস্ট ১৯৭১

বাংলা দেশ বনা রাষ্ট্র সংঘ
সত্যকাম সেনগুপ্ত

বাংলা দেশের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার পর চার মাস কেটে গেছে। এই চার মাসের মধ্যে প্রায় সব দেশেরই মতামত জানা গেছে। কেউ বা মুক্তি যোদ্ধাদের সমর্থন করছে, কেউবা সাহায্য করছে পাক সরকারকে। এই মতপার্থক্য দেখা দেওয়াটা খুবই স্বাভাবিক এবং কারণগত। নানান দেশের বিভিন্ন মতের মূলে রয়েছে মোটামুটি তিনটি কারণ। প্রথমতঃ, তাদের কাছে মুক্তি সংগ্রামের উপস্থাপনা ও ব্যাখ্যা কিভাবে করা হয়েছে। দ্বিতীয়তঃ, তাদের দেশের তথা বিশ্ব জনমত কি স্রোতে বইছে। তৃতীয়তঃ, এই মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে তাদের কোনো স্বার্থসিদ্ধি হবে কিনা।
কিন্তু এই চার মাসের মধ্যে যার মতামত সুস্পষ্টভাবে জানা যায়নি সেটি কিন্তু সকল দেশের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত। তার নাম রাষ্ট্রসংঘ (ইউনাইটেড নেশনস্)। বিগত চার মাসে এই রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক শ্রী উ থান্ট মহাশয় বাংলা দেশের মুক্তি সংগ্রাম বিষয়ে যে ক’টি বিবৃতি দিয়েছেন তা এক হাতের আঙুলেই গুণে ফেলা যায়। শুধু তাই নয়, এ মুক্তি সংগ্রাম যেন ভারত পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার, এ ধরণের মনোভাব নিয়ে তিনি রাষ্ট্রসংঘের তরফ থেকে পরিদর্শক নিয়োগ করার কথাও ঘোষণা করেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ সে প্যাঁচে ভারতকে ঠিক জড়ানো যায়নি।
এ ধরণের কোনো প্রস্তাব যে শ্রী থান্ট করতে চাইবেন তা একান্তই অকল্পনীয়। তবে, এই চার মাস ধরে শ্রী থান্ট নীরব নিশ্চয় হয়ে বাংলা দেশের মুক্তি সংগ্রামের যে বিরোধিতা করেছেন, সেটাও নেহাৎ কম নয়। এ ধরণের বিরোধিতা কোনো দেশ করলে তবু খানিকটা নেমে নেওয়া যায়। কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সব দেশের মুখপাত্র রাষ্ট্রসংঘের প্রধানের এ ধরণের ব্যবহার অত্যন্ত অমার্জনীয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে, রাষ্ট্রসংঘ এরকম আচরণ করল কেন? রাষ্ট্রসংঘের নিজস্ব বহু প্রতিনিধি বাংলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ সংগ্রহ করে নিয়ে গেছেন। কাজেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মিথ্যে উপস্থাপনা বা ভুল ব্যাখ্যাতে আর যে কোনো দেশ বিশ্বাস করুক না কেন, রাষ্ট্রসংঘ সে রকম ভুল করবে না। আর, এ ব্যাপারে রাষ্ট্রসংঘের কোনো স্বার্থ থাকা উচিত নয়, কারণ বিশ্ব জনমতের প্রবক্তা তো রাষ্ট্রসংঘই।
অবশ্য এরকম ঘটনা রাষ্ট্রসংঘের ইতিহাসে খুব নতুন নয়। কাজেই রাষ্ট্রসংঘ সম্বন্ধে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করাটা অর্থহীন হবে। এখন একটি মাত্র প্রশ্নই রাষ্ট্রসংঘ সম্বন্ধে করা যেতে পারে। তা হলো, রাষ্ট্রসংঘ নামক বিরাট আন্তর্জাতিক ধাপ্পা প্রতিষ্ঠানটি কবে বন্ধ করা হবে? রাষ্ট্রসংঘের সনদটা নিয়ে সামান্য নাড়াচাড়া করলেই তো বোঝা যায় যে রাষ্ট্রসংঘ তার উদ্দেশ্য সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে ফেলেছে।
রাষ্ট্রসংঘের সনদের ঘোষণাপত্র একটি বিখ্যাত বস্তু। এ রকম আদর্শ, মানবিকতা ও বড় বড় কথায় বোঝাই ঘোষণাপত্র সম্ভবতঃ আর নেই। সেটা পড়লেই পাঠকের মনে হবে যে তিনি যেন এই সব আদর্শগুলি সফল হওয়ার আশায় বসে ছিলেন। এবং মনে মনে পাঠক রাষ্ট্রসংঘের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হবেন। কিন্তু এই ঘোষণাপত্রকে প্রয়োজনের সময়ে শিকেয় তুলে রেখে রাষ্ট্রসংঘ বারম্বার চরম স্বেচ্ছাচারিতা করেছে। অন্য সব উদাহরণ বাদ দিয়ে শুধু বাংলা দেশের ব্যাপারেই রাষ্ট্রসংঘের ব্যর্থতার একটু আলোচনা করা যাক। এ জন্য রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণাপত্রের সঙ্গে বাঙলা দেশের ঘটনাবলীর তুলনা নীচে দেওয়া হল :-

রাষ্ট্রসংঘের ঘোষণাপত্রে বলা হয়েছে :- [ বন্ধনীর অন্তর্গত মন্তব্যগুলি আমার—লেখক ]
আমরা, রাষ্ট্রসংঘের অন্তর্গত জাতিসমূহ, স্থির করিয়াছি যে, পরবর্তী বংশধরদিগকে আমরা যুদ্ধের বিভীষিকা হইতে রক্ষা করিব, কারণ যুদ্ধ আমাদের জীবিতকালেই দুই দুইবার মানবজাতির প্রতি অবর্ণনীয় দুঃখ বহন করিয়া আনিয়াছে।…

[ পাঠক, চমকে উঠবেন না—রাষ্ট্রসংঘ আসলে যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাংলাদেশবাসীকে রক্ষা করতে চান। তাই এতদিন রাষ্ট্রসংঘ চুপচাপ অপেক্ষা করছিলেন কখন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সমস্ত বাঙালীকে খতম করে ফেলে; কারণ তাহলে আর যুদ্ধ করার জন্য কেউ বাকি থাকবে না। কিন্তু সেটা রাষ্ট্রসংঘের হিসেব মাফিক হয়ে ওঠেনি। বরং পশ্চিম পশ্চিম পাকিস্থানী সৈন্যদের অবস্থাই ক্রমাগত সঙ্গীণ হয়ে উঠছে। অবশেষে রাষ্ট্রসংঘ হতাশ হয়ে পর্যবেক্ষক পাঠানোর নাম করে ভারত পাকিস্থানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধিয়ে তোলার উপক্রম করছেন। ]
…এবং মানুষের মৌলিক অধিকারে বিশ্বাস ফিরাইয়া আনিব মানুষের মান-সম্মানের পুনরুদ্ধার করিব, পুরুষ নারী এবং বিভিন্ন দেশগুলির সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা করিব।
[ বটেই তো! মানুষের সবরকম মৌলিক অধিকার আজ বাংলা দেশে অবহেলিত হচ্ছে, মান-সম্মানের কথা তো ছেড়েই দেওয়া গেল। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের বক্তব্য কি? ]
…এবং এমন অবস্থার সৃষ্টি করিব যাহাতে ন্যায় এবং নানাপ্রকার আন্তর্জাতিক চুক্তি ও আইন সসম্মানে পালিত হয়।…
[ বাংলাদেশে চার মাস ধরে কোন আদালত চলছেনা; অর্থাৎ ন্যায় বলে কোন বস্তুর অস্তিত্বই নেই। শুধু চালু আছে সামরিক আদালত, যাতে বিচারের একমাত্র শাস্তি হলো একটি বুলেট। এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসংঘের অন্তর্গত ‘আন্তর্জাতিক ন্যায়ালয়’ একটু খোঁজ নেবেন কি? ] …এবং সামাজিক উন্নতি ও জীবনযাত্রার উন্নততর মানের জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করিব।…
[ পাকিস্তান তার পশ্চিমাংশেই উন্নতি ঘটিয়েছে, পূর্বাংশে নয়। সামাজিক সম্পর্কেরও অবনতি হয়েছে গত তেইশ বছর ধরে। এ তথ্যটা বোধহয় তেইশ বছর ধরে রাষ্ট্র সংঘের অজানা ছিল। আজ যেই এই বৈষম্যের প্রতিবাদে বাংলাদেশ অস্ত্রধারণ করেছে, অমনি রাষ্ট্রসংঘ পর্যবেক্ষক পাঠাতে উৎসাহী হয়ে উঠেছেন। ]
…এবং এই সব সদিচ্ছা পূরণের জন্য সহ্যগুণ শিখিব এবং পরস্পর সুপ্রতিবেশী হইয়া থাকার চেষ্টা করিব।…
[ এই সদিচ্ছা পূরণের চেষ্টার এত আধিক্য হয়ে গেছে যে পাক সরকার কর্তৃক ভারতকে বারবার যুদ্ধের উস্কানি দেওয়া হয়েছে অবশেষে পাক সরকার বাংলাদেশের ওপর পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা চালাচ্ছেন। ] …আমাদের শক্তি পুঞ্জীভূত করিয়া বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষায় সচেষ্টা হইব।…
(চলবে)

সম্পাদক—নুরুল আলম ফরিদ।। সহ-সম্পাদক—সন্তোষ কুমার চৌধুরী ।। বার্তা সম্পাদক—আমিনুল ইসলাম ।। কর্মাধ্যক্ষ—মহম্মদ ইউসুফ নাহিদ কর্ত্তৃক চাপা প্রেস বাংলাদেশ হইতে মুদ্রিত ও রফিক হায়দার রবিন কর্ত্তৃক প্রকাশিত।

সূত্র: বিপ্লবী বাংলাদেশ ফাইল

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!