You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পীরজাদার প্রস্তাবের অনুকুল প্রতিক্রিয়া
করাচী সমুদয় মহলে সন্তোষ

১১ই এপ্রিল ভাষা সমস্যার প্রশ্নটি গণপরিষদে যথাসময়ে আলােচিত হওয়ার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য পীরজাদা আবদুস সাত্তার যে মূলতবী প্রস্তাব করিয়াছেন, তাহাতে পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশের সদস্যগণই শুধু অভিনন্দন জানান নাই অধিকন্তু ইহা পরিষদের ভিতর ও বাহিরে এক সৌহার্দ্যপূর্ণ আবহাওয়ার সৃষ্টি করিয়াছে। জনাব নাজিমউদ্দিন বিষয়টি সম্পর্কে সচেষ্ট হইয়া গত চারিদিন যাবৎ ক্রমাগত বিভিন্ন দলের সহিত ও ব্যক্তিগতভাবে অনেকের সহিত যে আলােচনা করিয়াছেন এবং অবশেষে বিষয়টি সম্পর্কে যে একটা মীমাংসায় পৌছিতে পারিয়াছেন তজ্জন্য তিনি ধন্যবাদ। উল্লেখযােগ্য যে পীরজাদার প্রস্তাবটি পূর্ব পাকিস্তানের মােছলেম লীগের সদস্যদের দ্বারা গঠিত প্রতিনিধিদলের সম্মুখে রচিত ও পেশ করা হয়। প্রত্যেকেই এই প্রস্তাবে সস্তুষ্ট হন। ভাষার প্রশ্ন মুলতবী রাখার ৩টি পীরজাদার প্রস্তাব বিশেষ মনােযােগের সহিত পাঠ করিলে জিনিস পাওয়া যায়। প্রথমতঃ গণপরিষদ কর্তৃক স্বীকার লওয়া হইয়াছে যে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে এখনও কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাই। পূর্ব পাকিস্তানীদের মধ্যে এরূপ একটা ধারণা ছিল এবং এখনও আছে যে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা হইয়াছে। এখন গণপরিষদের এই স্বীকৃতি হইতে ইহাই প্রমাণিত হইল যে, গণপরিষদ ইতিপূর্বে কখনও সরকারীভাবে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন নাই যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে। তবে দুই একটি ক্ষেত্রে কায়েদে আজম ও মরহুম লিয়াকত আলী খান বলিয়াছিলেন যে, একমাত্র উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, কারণ দেশ বিভাগের পূর্বে উর্দুই ভারতের মুসলমানদের একমাত্র ভাষা ছিল। এই প্রস্তাব হইতে ইহাও পরিষ্কার হইয়া উঠিল যে, গণপরিষদ গত নভেম্বর অধিবেশনে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ সম্পর্কে সরকারীভাবে কোন প্রস্তাব গ্রহণ করে নাই। বস্তুতঃ রাষ্ট্রভাষা কি হইবে তাহা কখনও স্থির করা হয় নাই।
দ্বিতীয় বিষয়টি হইল, রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে কখনই কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা নাই এবং যেহেতু এখনও কোন রাষ্ট্রভাষা স্থিরীকৃত হয় নাই সেহেতু পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদগুলিতে ইংরেজীতেই কাজ চালানাে হইতেছে রাষ্ট্রভাষা স্থিরকৃত না হওয়া পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই চলিতে থাকিবে। রাষ্ট্রভাষা এখনই স্থিরকৃত হউক বা পরে হউক আমাদের এমন কোন আশকার কারণ নাই যে, রাতারাতি আমাদিগকে রাষ্ট্রভাষা শিখিয়া লইতে হইবে। ১৫ কি ২০ বৎসরের মধ্যে ইংরেজী ভাষাকে অপসারণ করা সম্ভব হইবে না। অন্ততঃপক্ষে দশ বৎসরের মধ্যে এরূপ হওয়া সম্ভব নয়, সুতরাং এমতাবস্থায় ইহাই উপলব্ধি করা হইতেছে যে, এই প্রশ্ন সম্পর্কে এখানে এবং এখনই কোন চাপ দেওয়ার কোন প্রয়ােজনীয়তা নাই। কারণ ইহা দ্বারা শুধু পাকিস্তানের মধ্যে অনাবশ্যক তিক্ততারই সৃষ্টি হইবে। মূলতবী প্রস্তাবের তৃতীয় উল্লেখযােগ্য বিষয়টি হইল, যখন উপযুক্ত সময়ে এই প্রশ্নটি গণপরিষদের নিকট পেশ করা হইবে। তখন এই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হইবে।
ইহাতে এই সিদ্ধান্ত হইল যে, উর্দু বাংলা অথবা অন্য যে কোন ভাষার জন্যই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দ্বার খােলা রহিল। সদস্যগণ যখনই মনে করিবেন তখনই বিষয়টি গণপরিষদে পেশ করিয়া তৎসম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারিবেন। ইহার জন্য সময়ের কোন সীমারেখা নির্ধারিত করিয়া দেওয়া হয় নাই। পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণও এই ব্যবস্থায় সষ্ট। শেষ কথা হইল, অতঃপর আর কোন ব্যক্তিই তিনি যত বড় পদস্থ ব্যক্তি হােন না কেন কোন নির্দিষ্ট ভাষার নাম করিয়া এমন কথা বলিতে পারিবেন না যে একমাত্র ইহাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে। কারণ কোন ব্যক্তিই বা দল বিশেষ নয় একমাত্র গণপরিষদই এই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবেন।
এখন প্রশ্ন হইল পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ হইয়াও কোন ভাষা সম্পর্কে এই মূলতবী প্রস্তাব সমর্থন করিলেন। ইহার কারণ হইল এই যে, যেহেতু পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণ সংখ্যাগরিষ্ঠ সেইহেতু এমন কোন প্রশ্ন উঠতে পারে না যে পশ্চিম পাকিস্তানীকে সন্তুষ্ট করার জন্যই বিষয়টি মুলতবী রাখা হইয়াছে। অথবা এমন কোন কথাও হইতে পারে না যে পূর্ব পাকিস্তানের সদস্যগণকে এই প্রস্তাব সমর্থন করিতে বাধ্য করা হইয়াছে।
যখন কায়েদে আজম ঘােষণা করিয়াছেন যে, উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হইবে তখন অবস্থা ছিল অন্যরূপ। তখন তাহার এই ঘােষণার তীব্র প্রতিবাদ করা হইয়াছিল। কিন্তু বর্তমানে যে প্রকারেই হউক, যখন এই প্রশ্ন উঠিয়াছে যে, বাংলাও পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হইতে পারে, তখন ইহাকে একটি নতুন সমস্যা জ্ঞানে ইহার সমাধান করিতেই হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানের সকলেই যখন সৰ্ব্বসম্মতভাবে এই দাবী উত্থাপন করিয়াছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদেরও এই দাবীর গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে হইবে। পূর্ব পাকিস্তানীদের মতের বিরুদ্ধে তাহাদের উপর উর্দুকে চাপাইয়া দেওয়া চলে না তেমনি পশ্চিম পাকিস্তানীদের
মতের বিরুদ্ধে তাহাদের উপরেও বাংলা ভাষাকে চাপাইয়া দেওয়া চলে না। জনাব নূরুল আমীন তাহার বক্তৃতায় বলিয়াছেন যে ভাষার প্রশ্ন সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানীরা কতটুকু উদ্বিগ্ন, পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইগণকে সেই সম্পর্কে ওয়াকেবহাল করাইতে হইবে। পরিষদ সদস্যগণ ও মােছলেম লীগ নেতৃবৃন্দ সকলেই পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার খাতিরে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। কারণ তাহার বিশ্বাস সে, প্রথমে পারস্পরিক ও পরে সংখ্যাগুরু ভােটের সাহায্যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই উৎকর্ষ বােঝাপড়া ও পরে সংখ্যাগুরু ভােটের সাহায্যে সকল বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই উৎকর্ষ পন্থা, যখন পূর্ব পাকিস্তানী গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখন কেন তাহার তাহাদের পশ্চিম পাকিস্তানী ভাইগণকে পূর্ব পাকিস্তানীদের দাবী সম্পর্কে বুঝাবার সময় দিবেন না?
যাহা হােক হিন্দু সদস্যদের অসস্তুষ্টি ও বিরক্তির কারণ হইলেও পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সকল মােছলেম লীগ সদস্য সর্বসম্মতভাবে ভাষা সম্পর্কে মুলতবী প্রস্তাব সমর্থন করিয়া দেশকে বিভেদ ও দলাদলি সৃষ্টির এবং শত্রুর ষড়যন্ত্র হইতে রক্ষা করিয়াছেন।
ঢাকা প্রকাশ
১৩ এপ্রিল, ১৯৫২
পৃ. ৭

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!