ভাষা আন্দোলনে শহীদগণের প্রতি ঢাকায় নাগরিকদের শ্রদ্ধাঞ্জলী
গত বৎসর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা শহীদ হইয়াছিলেন তাহাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন উপলক্ষে গতকল্য ঢাকায় যে শহীদ দিবস উদযাপন করা হয়, তাহা সৰ্বদিক দিয়ে সাফল্য মণ্ডিত হইয়াছে।
বিভিন্ন স্তরের ও বিভিন্ন শ্রেণীর অধিবাসী এবং বিশেষ করিয়া বহু মহিলা নগ্নপদে ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে পরিচালিত দীর্ঘ শােভাযাত্রা সহকারে শহর প্রদক্ষিণ করে।
এই বিরাট শশাভাযাত্রায় অংশ গ্রহণকারীগণের অনুকণ্ঠের রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই। প্রভৃতি ধ্বনিতে সমগ্র শহর মুখরিত হইয়া উঠে।
সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে শহরের উল্লেখযােগ্য মােড়সমূহে পুলিশ পাহারা মােতায়েন ছিল। তাহারা শােভাযাত্রা যাহাতে সুশৃঙখলভাবে পরিচালিত হয় তাহার সহায়তা করে।
শনিবার ছােবে সাদেকের সাথে সাথে দলে দলে নগরবাসী আজিমপুর কবরস্থানে যাইয়া শহীদগণের রুহের মাগফেরাত কামনা করে ও কবরে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে।
অতঃপর বেলা সাড়ে দশটা হইতে দলে দলে ছাত্র-ছাত্রী আসিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হইতে থাকে। সকাল হইতেই শহরের সমস্ত যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে এমনকি রাস্তায় একজন সাইকেল আরােহীকেও দেখা যায় নাই। কেবলমাত্র ডাক্তারখানা ছাড়া শহরের সমগ্র দোকান বন্ধ রাখিয়া সকলে যথাযথভাবে শহীদের স্মৃতির প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।
বেলা ১২টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শােভাযাত্রীগণ আসিয়া সমবেত হয় এবং ১২টার সময় শােভাযাত্রীগণ তথা হইতে সুশৃঙখুল ও সুনিয়ন্ত্রিতভাবে বাহির হয়। শােভাযাত্রীগণ শােক জ্ঞাপক কালােপতাকা, কালাে ব্যাজ ধারণ করতঃ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই প্রভৃতি সহকারে অগ্রসর হইতে থাকে।
শােভাযাত্রার সম্মুখভাগে পাকিস্তান এম্বুলেন্স কোর এর একখানি জীপ গাড়ী প্রাথমিক চিকিৎসার ঔষধপত্রসহ অগ্রসর হয়। শােভাযাত্রার পুরােভাগে সাইকেল আরােহী দল এবং তাহার পশ্চাতে ছিলেন শহীদ দিবস আহবানকারী দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণের মধ্যে জনাব আতাউর রহমান, কাজী গােলাম মাহবুব ওয়াদুদ। জনাব আবদুল ওয়াদুদই শােভাযাত্রা পরিচালনা করেন। এই দলের পেছনে স্কুল ও কলেজের ছাত্রী ও অন্যান্য মহিলাগণ নগ্নপদে অগ্রসর হন।
শােভাযাত্রীগণ মেডিকেল কলেজের সম্মুখ দিয়া পরিষদ ভবনের পাশ দিয়া ময়মনসিংহ রােড হইয়া প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সম্মুখ দিয়া রমনা এলাকায় প্রবেশ করে। তথা হইতে সেক্রেটারীয়েট পুরান পল্টন, নবাবপুর রােড, এছলামপুর ও চকবাজার হইয়া জেলখানার সম্মুখ দিয়া অম্মানীটোলা ময়দানে বিনা বাধায় বেলা প্রায় তিনটার সময় আসিয়া উপস্থিত হয়। তথায় জনাব আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে এক সভা হয়। ক্রমে ক্রমে জনতার সংখ্যা বাড়তে আরম্ভ করে এবং বেলা চারটার সময় ময়দানে আর তিল ধারণের জায়গা থাকে না। সভায় শহীদ দিবস পালনের স্বার্থকতা সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তা বক্তৃতা করেন। আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সেক্রেটারী জনাব মুজিবুর রহমান সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, গত বৎসর ঠিক এমন দিনে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে চার কোটি অধিবাসীর ভাষা বাংলাকে আজাদ পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার দাবীতে ঢাকা শহরে ছাত্র ও জনসাধারণ নির্ভীকভাবে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়াছে। তাহারা সেইদিন যে নতুন ইতিহাস রচনা করিয়াছে, সমগ্র জাতি তাহা চিরদিন শ্রদ্ধার সহিত স্মরণ করিবে। ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে তিনি “জাতীয় কারবালা দিবস” বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, আজ পাকিস্তান সরকারের সম্মুখে শুধুমাত্র দুইটি পথ খােলা রহিয়াছে। হয় তাহারা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে মানিয়া লইবেন, নতুবা গদি ছাড়িবেন। তিনি সকল রাজবন্দীর আশু মুক্তি এবং নিরাপত্তা আইন প্রত্যাহার করিবার জন্যও দাবী জানান।
রাষ্ট্রভাষা কৰ্ম্ম পরিষদের কাজী গােলাম মাহবুব বলেন যে, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকৃতি না দিয়া সরকার যে মনােভাবের পরিচয় দিয়াছেন, তাহা নিতান্তই অগণতান্ত্রিক। তিনি সরকারের এই মনােভাবের তীব্র নিন্দা করেন।
গণতন্ত্র দলের সাধারণ সম্পাদক জনাব মাহমুদ আলী বলেন যে, রাষ্ট্রভাষার দাবীকে ভিত্তি করিয়া প্রদেশব্যাপী যে, স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন গড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা ভাষাকেন্দ্রিক আন্দোলন নয়, সামগ্রিকভাবে ইহা পূর্ব-পাকিস্তানের অধিবাসী আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের আন্দোলন।
মােসাম্মৎ হালিমা খাতুন বলেন যে, কোন জাতির মাতৃভাষার দাবীকে অস্বীকার করিবার অর্থ সে জাতির শিক্ষা সংস্কৃতি কৃষ্টির মূলে কুঠারাঘাত করা। তিনি আরও বলেন যে, পূর্বপাকিস্তানবাসীর এই আন্দোলন, শুধু ভাষা আন্দোলনই নয় ইহা তাহাদের জীবন ধারণের লড়াই।
সভাপতির অভিভাষণে জনাব আতাউর রহমান রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে পাকিস্তান সরকারের নীতিকে ভেদনীতি বলিয়া অভিহিত করেন। তিনি বলেন যে, পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ সরকারের হীন নীতিকে কোনমতেই মানিয়া লইবে না বলিয়া দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং ভাষা আন্দোলনই তার অভিব্যক্তি।
সভায় তােলাবায়ে আরাবিয়ার সম্পাদক জনাব শহীদুল হক, রিক্সালীগের সম্পাদক জনাব সেলিম, সিভিল লিবার্টি লীগের সম্পাদক জনাব সৈয়দ আবদুর রহিম, নিখিল পূর্ব-পাকিস্তান, ছাত্রলীগের জনাব আখতারউদ্দিন, এছলামী ভ্রাতৃসংঘের জনাব ইব্রাহীম ছাড়া ছাত্রলীগের জনাব এ, ওয়াদুর, খেলাফত জনাব সােলায়মান খান প্রমুখ আরও অনেকে বক্তৃতা করেন।
সভায় সর্বশেষে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে দাবী করিয়া এবং রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে মােছলেম লীগের নীতির তীব্র নিন্দা করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
সভায় গৃহীত অপর দুইটি প্রস্তাবে অবিলম্বে মাওলানা ভাষানী সহ অপরাপর সকল রাজবন্দীর বিনা শর্তে মুক্তি এবং নিরাপত্তা আইনের প্রত্যাহার দাবী করা হয়। ইহা ছাড়া সভায় ভাষা আন্দোলনের শহীদদের রুহের মাগফেরাত কামনা করা হয়।
ঢাকা প্রকাশ
২২ ফেব্রুয়ারী, ১৯৫৩
পৃ.-৫
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত