You dont have javascript enabled! Please enable it!

মাতৃভাষা
ইদ্রিস মিঞা, অধ্যাপক, ঢাকা কলেজ

শ্যামল স্নিগ্ধ ধরণীর এক নিভৃত কোণে মানবশিশু ভূমিষ্ঠ হয়ে সর্ব প্রথম মাতৃমুখই নিরীক্ষণ করে। দুনিয়ার সুখ-দুঃখ হাসি-কান্না, যখন নিয়মিতভাবে চলতে থাকে তখন পৃথিবীর এক প্রান্তে এই যে, নুতনের আবির্ভাব উহা সাময়িক হলে ও চিরন্তন রীতির বার্তাই বহন করে আনে। সেই জীবনের প্রভাব তরুণােদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সে শুধু স্নেহময়ী জননীর ভাষাহীন অধর ও স্নেহ সঞ্চিত দৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত হয়। দুনিয়ার কল-কাকলীর সঙ্গে যেন এর একটা অজ্ঞাত পার্থক্য। মায়ের করুণ কোমল দৃষ্টি যেন শিশুকে পার্থিব আবিলতা মুক্ত করে রাখে। মার এই নব দৃষ্টিপাতের অর্থ সে না বুঝলেও হৃদয়ে অনুভব করে এবং অপরিচিত পৃথিবীতেও একান্ত নির্ভয় সে আর কোমল বাহুযুগল দ্বারা মার বক্ষ আলিঙ্গন করে স্বস্তির নিশ্বাস ত্যাগ করে। তার এই নিতান্ত নির্ভরতা ক্রমশঃ তাকে দুনিয়ার সঙ্গে পরিচিতি করিয়ে দেয়।
পৃথিবীর প্রতিটি প্রাণীরই ভাব প্রকাশের ভাষা আছে। পশুপাখি প্রভৃতি ইতরপ্রাণী জন্মের পরই তার আশ্রয় স্থল চিনে নেয় ও ভাষা আয়ত্ব করতে পারে। কিন্তু মানবশিশু জন্মের পর থাকে একান্ত দুর্বল, অসহায়ভাবে সে তার জীবনের জন্য পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকে। তার মাই তাকে, এ বিপদ সমুদ্র থেকে জীবন ধারণের দুঃখ থেকে বাচিয়ে তােলে তিলে তিলে। স্বর্গভ্রষ্ট হলেও মানবশিশু ধুলি মলিন পৃথিবীতেই স্বর্গের আভাষ পায় প্রথমতঃ মাতৃস্নেহের কাছে, দ্বিতীয়তঃ মায়ের ভাষার কাছে। মাই তাকে জীবনপথের পথিক বানিয়ে তােলে, ভাষা শিক্ষা দ্বারা তাকে করে তুলে শ্রেষ্ঠ মানুষ। মার মুখ নিঃসৃত বাণী শিশুর নিকট অমৃত সদৃশ। শরৎকালের আকাশ থাকে স্বচ্ছ, মেঘহীন, মাঝে মাঝে সাদা মেঘের টুকরাে ভেসে এসে আকাশকে করে তােলে রমণীয়। শিশুমন ও শরৎকালীন আকাশ। আকাশের সীমাহীন বিশালতা তার মনের না থাকলেও স্বচ্ছতা আছে, তাই তার হৃদয়ে মায়ের কথাগুলাে মেঘের ফালির মত ভেসে বেড়ায়। প্রথমতঃ কোন ছাপ থাকে না, কিন্তু ভাবীকালের সম্ভাবনার বীজ থাকে উপ্ত, যেমন থাকে শরৎ মেঘে ধারা বর্ষণের ইঙ্গিত। শিশুমনকে দর্পণের সঙ্গেও তুলনা করা চলে। দর্পণ যেমন নির্বিচারে সব কিছুর ছায়াকেই নিজ বুকে স্থান দেয় তেমনি শিশু মনও সমস্ত কিছুই বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করে। কোন প্রশ্ন করে না, যুক্তি দেখায় না।
শিশু সর্বপ্রথম মায়ের ভাষাকেই আধাে আধাে বুলির সাহায্যে অনুকরণ করে। অস্ফুট ভাষা স্ফুটতর হতে হতে বিচ্ছিন্নগতি প্রবাহ পায় ক্রমে ক্রমে। এক প্রকার স্বতঃস্ফূর্তভাবেই ভাষা আপনার রূপ নিয়ে শিশু মনে আপন আসন দখল করে নেয়। শিশুর মন ভক্তির প্রয়ােজনের তাগিদে অথবা অবশ্যম্ভাবী পরিণতিরূপে ভাষাকে গ্রহণ করে নি। তার হৃদয় স্বতঃই মায়ের ভাষাকে আপনার বলে গ্রহণ করেছে।
কোন মনীষী বলেছেন যে শিশু মায়ের কাছে থেকে যা কিছু শিক্ষা করে তা তার সমস্ত জীবনের শিক্ষার চাইতেও অধিকতর দামী। কথাটা অনেকাংশেই সত্য। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হয় যে, শিশুমনে মায়ের প্রভাব ছাড়া অন্য প্রভাবও এসে পড়ে, উহা বাইরের।
ভাষা সৃষ্টির ইতিহাস আলােচনা করলে দেখা যায় যে, বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ভাষার গাঁথুনি গড়ে তােলে। নদীর স্রোতের মত উহা সর্পিল ও স্বতন্ত্র। নদীর স্রোতে থাকে যেমন দুই পার্শ্বের গ্রামের ইতিহাস, তেমনি ভাষাতেও থাকে তার পারিপার্শ্বিকের পরিচিতি। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে ভাষার গঠন কাৰ্য্য শুরু ও শেষ হয়। এইজন্য পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন ভাষা থেকে মানবজাতির বৈশিষ্ট্য ও নিরুপণ সম্ভবপর হয়। কোন কোন ভাষার প্রাকৃতিক পরিবেশের ছাপ অনেক সময় এমন বেশী থাকে যে, উহা স্থান বিশেষে অনেক সময় আলাদা ভাষা রূপেও গণ্য হইতে পারে। বাংলার বিভিন্নজেলা অথবা মহকুমার প্রাদেশিক ভাষার অস্তিত্বেই এই প্রমাণ। বাংলাতে রাষ্ট্রের ভাষায় ও পূর্ববঙ্গের ভাষার যেন একটা আকাশ পাতাল পার্থক্য দৃষ্ট হয়। উহা প্রাকৃতিক প্রবাহের ফল ছাড়া আর কিছুই নয়। সােজা কথায় স্থানীয় জলবায়ু যেমনভাবে মানুষের দৈহিক গড়ন, আচার ব্যবহার, পােশাক পরিচ্ছদ প্রভৃতির উপরে প্রভাব বিস্তার করে তেমনি উহার ভাষাকেও অজ্ঞাতসারে প্রভাবিত করে।
আরও কতকগুলি কারণ ভাষা গঠনের মূলে রস সিঞ্চন করে উহা সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় প্রভাব ভাষাকে সংকীর্ণতার গণ্ডীর মধ্যে ফেলে দেয় সত্য, কিন্তু উহা একটা বিশেষ সম্প্রদায়ের প্রাণের প্রতিধ্বনি বহন করে। রাজনৈতিক প্রভাব ভাষাকে আর একটু বৃহত্তর পরিধির সহিত পরিচয় করিয়ে দেয়। তখন উহা হয়তাে বিভিন্ন ভাষা হতে চৌথ সংগ্রহ করে নিজের কলেবর পুষ্ট করে। ইহা ভাষার প্রাণপ্রাচুর্যের লক্ষণ। বাইরের প্রভাবকে উহা অনেক সময় স্বীকার করে নেয় শুধুমাত্র বাহ্যিক আচরণ হিসেবে, নিজের আসল রূপ তাতে বৈশিষ্ট্য হারায়। এই পরিবর্তন সাময়িক না হলেও বাইরের প্রভাবকে শক্তিশালী ভাষা একেবারে নিজের জারক রসে হজম করে নিজের রক্তমাংসের সঙ্গে এক করে নিজের কায়িকশক্তির বৃদ্ধি সাধন করে।
উপরের আলােচনায় দেখা গেল, ভাষা সৰ্ব্বদাই নিজের বৈশিষ্ট্য নিয়ে আপন গতিতেই চলছে। উহার স্বাভাবিক গতিধারাকে কেহ রােধ করতে পারে না, রােধ করতে গেলে নদীর স্রোতের মত উহা আপনার পথ বন্ধ রেখে নিজের গতি নিজেই স্থির করে নেয়। এটা প্রাকৃতিক নিয়ম।
এইভাবে নানা প্রকার পলি দ্বারা যে ভাষা শৈলী গঠিত, উহা ফসল ফলানাের পক্ষে উপযােগী। বিভিন্ন শক্তির সমন্বয়ে গঠিত শঙ্কর ভাষাই শিশুমনে প্রথমতঃ প্রভাব বিস্তার করে। শিশুর শারীরিক বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাষার প্রকৃত রূপের সঙ্গে সে পরিচিত হয়। তখন আর অন্তর ও বাহিরের সঙ্গে ভাষার অন্তর ও বাহিরের কোন বৈসাদৃশ্য থাকে না। বিভিন্ন সূত্রে সংগৃহীত উপকরণের ভাষা তিলােত্তমার সৃষ্টি উহা সম্পূর্ণতার পরিচায়ক। শিশুর প্রতিটি নিশ্বাসের সঙ্গে এই ভাষার হৃদস্পন্দন বাজতে থাকে, সুতরাং ভাষা প্রকৃতি ও মানুষ এক হয়ে। গিয়ে আপনাদের অন্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠায় ব্রতী হয়।
এই ঐক্যই স্বাভাবিক মায়ের মুখের ভাষাই আমাদিগকে এক বিরাট ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করে। আমাদের সমাজ, ধৰ্ম্ম, জাতি, ইতিহাস, তাহজীব তমদুনের মূলে থাকে এই মাতৃভাষার অবদান। মাতৃভাষার সাহায্যেই আমরা বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্বারােদঘাটন করতে পারি।
নিজের ভাষায় যত সহজে কোন ভাব প্রকাশ করিতে পারা যায়, অন্য কোন ভাষায়। তাহা হয় না। কারণ বিদেশী ভাষায় যতবড় পণ্ডিতই কেহ হউক না কেন তাকে নিজের উপার্জিত শক্তির অপচয় করে কষ্ট কল্পনায় আশ্রয় নিতে হয়। অবশ্য বিদেশী ভাষা শিক্ষা করে যে কোন পাণ্ডিত্য অর্জন করতে পারে না তাহা সর্বৈব সত্য হলেও উহা সৰ্ববাদী সম্মত সত্যও নয়। কিন্তু এতে কেহ সত্যিকারের প্রাণের স্পন্দন পায় না। অন্তরের পিপাসা মিটাতে পারে না। শিক্ষার হেরফের মেটাতেই জীবনের সার অংশ শেষ হয়ে যায়। বিদেশী ভাষার শিক্ষা আমাদের অন্তরের সঙ্গে না মেশাতে উহা পােশাকী শিক্ষা হয় ও অনেক সময় আমাদের নােট বইয়ে লিপিবদ্ধ থাকে। আমাদের প্রাণের প্রয়ােজনে উহা গ্রহণ করি না।
প্রয়ােজনের তাগিদে মানুষ ভাষার সৃষ্টি অবশ্য করে নি, কিন্তু ভাষাকে মানুষ প্রয়ােজনে ব্যবহার করছে। ভাষার সাহায্যে জ্ঞান আহরণ মানুষের সঙ্গে মানুষের জগৎ জোড়া মিল বের করে যে মিল দেশ ভেদ ও কাল ভেদকে ছাড়িয়ে যায়। এই বিশ্বব্যাপী মিলের পরম আনন্দ পরিবেশনের ভার একমাত্র মাতৃভাষার হাতেই আছে। উহাই সত্যিকারভাবে মানুষের হৃদয়ের দুয়ারে সমস্ত দুনিয়া এনে হাজির করে।
বিদেশী ভাষাকে মানুষ আটপৌরে হিসেবে গ্রহণ করলে ও তার ভাবকে যদিনা নিজের ভাষার মাধ্যমে গ্রহণ করে তবে সে শিক্ষা অবাস্তব।
নিজ মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা না হলে শিক্ষার সঙ্গে ভাবের চিন্তার সঙ্গে অধীত বিদ্যার, কৰ্ম্মের সঙ্গে আদর্শের মিল থাকবে না। পরভাষা অনুকৃতিতে শুধু চাতুর্যে প্রকাশ পেতে পারে, কিন্তু শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য হয় ব্যর্থ। অভিধান যেমন শুধু শুদ্ধ সম্পদ বহন করে, কিন্তু জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সাহিত্যের আসরে তার স্থান নেই, তেমনি অনুকারী শুধুমাত্র শব্দ সমষ্টি বহনকারী সৃজনকারী নয়। মাতৃভাষা ছাড়া অপর ভাষায় যে চিন্তা, তাতে শক্তির অপচয় ঘটে। সাধারণের পক্ষে উহা মারাত্মক হয়ে দাড়ায়। বিদ্যা শিক্ষার উদ্দেশ্য ওতে প্রতিহত হয়। কারণ মাতৃভাষা অতিসাধারণভাবে আমাদের মনের দ্বারে তার আবেদন এনে পৌছে দেয়। অন্য ভাষার মারফত আনীত বিদ্যা আমাদের মনে মনে মাতৃভাষার অনুবাদ করে প্রকাশ করতে হবে, এতে ভাষার ও ভাবের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্ততা লােপ পায়, চিন্তার গ্রন্থিতে ফঁাক পড়ে যায়।
সাহিত্য শতদলের মধ্যে যে ঐক্যের সন্ধান পাই তা ভাষার প্রাদেশিক সংকীর্ণতাকে দূর করে, এক বিরাট ঐক্যবােধের মধ্যে আত্মপ্রতিষ্ঠা করে। মাতৃভাষা মানুষকে সাত্যিকারে মানুষরূপে গড়ে তুলতে পারে।
প্রত্যেকটি মানুষকে স্বাতন্ত্র্যবােধে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মাতৃভাষার দ্বারস্থ হতে হবে। এই ভাষার মারফৎ রাষ্ট্রীয় উন্নতি, তার কৃষ্টিগত উন্নতি, ধর্মীয় উন্নতি, কৃষ্টিগত বেশিষ্ট্য, তার প্রাচীন ইতিহাস উদ্ধার প্রভৃতি সম্ভবপর হতে পারে। যিনি ধার করা ভাষায় নিজের উন্নতি আশা করেন, তিনি ভ্রান্ত, কারণ প্রাকৃতিক নিয়মকে অস্বীকার করলে মানুষের জীবন-অচল হয়ে পড়ে। প্রকৃতি আমার অনুকূল না বলেও আমাকে প্রাকৃতিক নিয়মের চিরন্তরতা স্বীকার করতেই হবে।
এই জন্যই দেখতে পাই, ইংরেজ বিদেশে রাজ্য স্থাপন করা মাত্র তাদের সমস্ত শাসন নীতি প্রচার করেছিল নিজেদের ভাষার সাহায্যে। তাদের ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দিয়ে তারা এখন বিশ্বের দরবারে নিজেদের ভাষাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। অথচ কত অল্প লােক ইংরেজী ভাষায় কথা বলে, ভাষার স্বাধীনতাই মানুষের বড় স্বাধীনতা একথা ইংরেজ মনেপ্রাণে উপলব্ধি করেছিল। বাংলাদেশের অধিবাসীকেও নানাপ্রকার প্রলােভনের মায়াজালে সে এ ভাষাকে গ্রহণ করতে বাধ্য করেছিল এবং বাঙালী এক সময় ইংরেজীতে কথা বলাটা সম্মানের বিষয় বলে ধরে নিয়েছিল। ইংরেজদের সবকিছু আমাদের বাঙ্গালী মস্তিষ্ক ঘুলিয়া দিয়েছিল। ইংরেজী ভাষা যে আমাদের কিছুই দেয়নি একথা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। ইংরেজী আমাদিগকে আত্মবিস্মৃতির অতল তলে তলিয়ে দিয়েছিল। তাই আমরা এখনও হাফ বাঙ্গালী ও হাফ খৃষ্টানপশ্চাত্যশিক্ষা ও সভ্যতা আমরা নিজের ধাতস্ত করে গ্রহণ করি নি বলেই আজও আমাদের ইংরেজি পােষাকের নীচে বাঙ্গালী ধূতি চাদর লুকানাে আছে। অন্ধ অনুকৃতির এই কুফল।
নিজের ভাষার উপরে প্রত্যেক দেশেরই দরদ থাকে এটা সত্য কথা হলেও, সকল দেশ সম্বন্ধে একথা ঘটে না। বাঙালী তার বড় দৃষ্টান্ত, সেইজন্য সে তার ভাষাকে কোথাও সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করে নাই।
কোন বিশেষ ভাষাভাষী যদি আত্মসম্মান রক্ষায় পরাঙ্মুখ হয় তবে তাকে কে রক্ষা করবে ? আত্ম অস্বীকৃত জাতির ধ্বংসের পথ পরিষ্কার করে, এটা সত্য কথা। অন্য ভাষা শিক্ষায় আপত্তি নাই, কিন্তু মাতৃভাষাকে যদি পদচ্যুত করে দলবদ্ধ ভাষা, তবেই বিপদ মাংশাসী জন্তুর তৃণভােজন তার স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল নয়।
আরও একটা জিনিস দেখা যায়, লক্ষ্য করলে মাতৃভাষাই সর্বাগ্রে মানুষকে আত্মপরিচয় করিয়ে দেয় বলেই যুগে যুগে অবতীর্ণ ধর্মগ্রন্থগুলি ধর্ম প্রচারকও তার দেশের লােকের ভাষাতেই অবতীর্ণ হয়। দৃষ্টান্ত স্বরূপ কোরান ও বাইবেলের কথা উল্লেখ করা যায়। সমস্ত ভাষাই যদি খােদার সৃষ্টি সুতরাং তার নিকট সকল ভাষা সমান হইলেও তিনি ধৰ্ম্মগ্রন্থ নাজেল করার সময় “অহি” পাঠাবার সময় নবীর মাতৃভাষাকে উপেক্ষা করেন নি, বরং মাতৃভাষাকে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন বলে আমার মনে হয়।
পরভাষা অনুকৃতিতে অবশ্য দু একজন লােক স্বাতন্ত্র দেখিয়েছেন কিন্তু সাধারণতঃ বিদেশী ভাষা মাতৃভাষাকে স্থানচ্যুত করতে চেষ্টা করলে উহার সাধনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এটাই হল ঐতিহাসিক, ভৌগােলিক ও প্রাকৃতিক সত্য।
আমাদের বাংলা ভাষা শ্রুতিমধুর ও সমৃদ্ধ বলে কি কোন অসভ্য জাতি তাদের ভাষা পরিত্যাগ করে আমাদের ভাষা গ্রহণ করবে ? তা কখনই না যার যার কাছে তার তার ভাষা সুন্দর, বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। সঞ্জীব চন্দ্রের এ উক্তির সারবত্তা এখন বুঝতে পারি। মা স্নেহবশে কানা ছেলেকে পদ্মলােচন বলে থাকেন বলেই কি সে পদ্মলােচন হয়? তা হয় না, তবু মায়ের ভালবাসার এ প্রকাশ হয়। এমনই জগতের নিয়ম, এটাই চিরন্তন।
মাতৃভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত শিক্ষাই মানুষকে পরিপূর্ণ ইঙ্গিত দিতে পারে। পরিপূর্ণ সত্য আধি ও আধিদেবিকের সাহায্যেই প্রাপ্ত হওয়া যায়। মাতৃভাষার মাধ্যমে যে শিক্ষা উহাই মানুষকে পূর্ণভাবে শিক্ষিত করে তুলতে পারে সত্যিকারের নাগরিক, সত্যিকারের দেশপ্রেমিক, সত্যিকারের সত্য দ্রষ্টা ঋষি। এই স্বাভাবিক ভাষাকে বাদ দিয়ে যে শিক্ষা হয় উহা পূর্ণতার দাবী করতে পারে না। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। মাতৃভাষাকে অস্বীকার কোন জাতি কোন দিনই করে নাই, করতে পারে না, কারণ এটাই হচ্ছে তার জীবনের চাবিকাঠি। খাওয়া পরা যেমন স্বাভাবিক নিয়মে দৈহিক প্রয়ােজন মিটাতেই দরকার, তেমনি মাতৃভাষাও তার মানসিক প্রয়ােজন মিটাতে পারে।
ঢাকা প্রকাশ
১৫ ও ২২ এপ্রিল, ১৯৫১
পৃ. ৮

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!