জাতীয় জীবনে মাতৃভাষার প্রভাব
মুহীয়ু-দ-দীন, অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম মানবসৃষ্টির গােড়ার প্রশ্নের ন্যায় প্রথম ভাষা সৃষ্টি সমস্যাকেও সুধীগণ একটা জটিল বিষয় হিসাবে নানাভাবে আলােচনা ও গবেষণা করিয়া থাকেন। মানুষের আদি পিতা আদমের ভাষা সমন্ধে যত বাদানুবাদই থাকুক না কেন, বর্তমান সময়ের মানুষের ভাষার সূত্র যে মাতৃভাষা সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। শিশুর জন্ম এবং তাহার ক্রমবিকাশের ধারা ধীরভাবে লক্ষ্য ও পর্যবেক্ষণ করিলে ইহা সহজেই উপলব্ধি করা যায় যে, মাতৃভাষাকে কেন্দ্র করিয়াই শিশুর কচি মনের ভাব সৰ্ব্বপ্রথম ভাষাপ্রাপ্ত হয়। মাতৃভাষার মাধ্যমেই সে তার ক্ষুদ্র পরিবেশের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদান করিতে শিখে। ক্রমে ক্রমে মাতৃভাষার সাহায্যেই জগতের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সর্বোপরি মাতৃভাষার উপর প্রতিষ্ঠিত হয় তার ব্যক্তিত্বের সুদৃঢ় সােপান।
মায়ের প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি যেমন একটা সহজ প্রকৃতি তেমনই মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগও একটা প্রাকৃতিক ব্যাপার। জননী, জন্মভূমি ও মাতৃভাষা এই তিনটিকে ভালবাসা প্রত্যেক মানুষের একটা স্বভাবজাত প্রবৃত্তি। এই জন্যই মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম ইসলাম মাতৃভূমি ও মাতৃভাষাকে মায়ের সমপর্যায়ে শ্রদ্ধা করার জন্য উহাকে ঈমানের অংশ বলিয়া স্বীকার করিয়া লইয়াছে। হযরত মুহম্মদ (দঃ) বলিয়াছেন—“দেশাত্মবােধ ঈমানের পরিচয়”। দেশাত্মবোেধ মহান শিক্ষাকে কার্যকরী করিতে হইলে দেশের ভাষার কথাই সর্বপ্রথম আসিয়া পড়ে। মাতৃ ভাষাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহন করিয়া সভ্য জগতে উহার মান বাড়ানই সত্যিকারের দেশাত্মবােধের প্রমাণ। ভাষার উৎকর্ষ সাধন করিলেও উহা ভাবের উৎস হিসাবে আত্মপ্রকাশ করিতে পারে। আর মাতৃভাষা যত শক্তিশালী হইবে, তাহার ভাবও ততই উচ্চ ও মহান হইবে, ইহা সহজেই অনুমেয়। জগত যে কয়টি সম্পদশালী ভাষা জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহন হিসাবে বিদ্যমান রহিয়াছে, উহা বস্তুতঃ উক্ত ভাষাভাষী সুধীগণের মাতৃবােধ, স্বদেশ ও স্বজাতি প্রীতি প্রভৃতি মহৎগুণের সাক্ষ্যদান করিতেছে। মাতা ও মাতৃভূমির সহিত ওতপ্রােতঃভাবে জড়িত রহিয়াছে।
গভীরভাবে বিচার করিয়া দেখিলে ইহা সহজেই প্রমাণিত হইবে যে, জগতের প্রত্যেক বৈষয়িক ব্যাপারে মাতৃভাষার প্রয়ােগই সবচাইতে বিজ্ঞানসম্মত ও প্রগতিশীল নীতি। শিক্ষা ক্ষেত্রে মাতৃভাষার প্রয়ােগেই আধুনিক শিক্ষা-পদ্ধতি অনুমােদন করিয়া থাকে। যে জাতি মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করিতে পারে না, সে জাতির শিক্ষার বুনিয়াদ দুৰ্বল ও প্রগতি বিরােধী। পরাধীন ও অনুন্নত দেশের অবস্থা পর্যালােচনা করিলে ইহা সহজেই বুঝা যাইবে। ব্যক্তিগত জীবনে মাতৃভাষার প্রভাব অত্যন্ত প্রবল বলিয়াই যাবতীয় শিক্ষণীয় বিষয় মাতৃভাষার মাধ্যমে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত করা অপরিহার্য কর্তব্য। যে দেশে এই সনাতন নিয়ম বাধ্যতামূলকভাবে প্রবর্তিত হইয়া সে দেশের শিক্ষা কাঠামাে ততটা সুষ্ঠু ও সবল। বস্তুতঃ ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে সভ্যতা, কৃষ্টি ও নৈতিক উন্নতির প্রত্যেক স্তরে মাতৃভাষা গভীর প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে। এই জন্যই সাধারণতঃ মাতৃভাষার সাহায্যেই ধৰ্ম্ম প্রচার করা হইয়া থাকে। রাজনৈতিক মতবাদ জনপ্রিয় করিয়া তুলিবার জন্যও মাতৃভাষার প্রয়ােগ হইয়া থাকে।
আধুনিক সময়ে সুষ্ঠুভাবে দেশ শাসন করিতে হইলে মাতৃভাষাকেই রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করা ব্যতীত অন্য কোন উপায় নাই। রাষ্ট্র জনসাধারণের দৈনন্দিত জীবনের সহিত জড়িত। এমতাবস্থায় জনসাধারণ ও রাষ্ট্রের মধ্যে নিকট সম্বন্ধ স্থাপন করিতে মাতৃভাষাই সবচাইতে বেশী উপযােগী।
পৃথিবীতে যে কয়টি উন্নত ভাষা বর্তমানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বাহন হিসাবে বিদ্যমান রহিয়াছে, উহার মধ্যে বাংলা ভাষা অন্যতম। উনবিংশ শতাব্দীর শেষাংশে ও বর্তমান শতাব্দীর প্রথমাংশে বাংলা ভাষা বিশ্ব সাহিত্যে অনেক নতুন সৃষ্টির সূচনা করিয়াছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে নােবেল প্রাইজ পাইয়া বাংলা ভাষার মর্যাদা বাড়াইতে সমর্থ হইয়াছে। কবি নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় ইসলাম ধর্মের মূল শিক্ষা ও সৌন্দর্য্যের অবতারণা করিয়া মুসলিম জাহানের দৃষ্টি মাতৃভাষার দিকে আকর্ষণ করিতে পারিয়াছেন। বাংলা ভাষার এই ধারাবাহিক উন্নতির জন্য প্রত্যেকটি বাংলা ভাষাভাষী আজ গৌরব অনুভব করিতেছে। বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা, শুধু এই হিসাবেই গর্ব করাই আজ বাঙ্গালী সুধী সমাজের কাজ নহে। বরং স্বীয় মাতৃভাষাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের শক্তিশালী বাহন রূপে গডিয়া তুলিয়া বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষাই পরিণত করাই উপযুক্ত নাগরিকের প্রথম ও প্রধান কাজ।
বর্তমান সময়ে বাংলা ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষা চালাইবার যে ষড়যন্ত্র চলিতেছে উহার অনিবাৰ্য্য প্রতিক্রিয়া হিসাবে শিক্ষা, সংস্কৃতি, ধর্মানুরাগ, দেশাত্মবােধ, রাষ্ট্রীয় আনুগত্য ইত্যাদি ব্যাহত হইবে সন্দেহ নাই। অতএব রাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দকে এখন হইতে এরূপ ভায়াবহ প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত হইতে হইবে, এবং পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্যই পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের মাতৃভাষা বাংলাকে জাতীয় জীবনের সর্বত্র প্রয়ােগ করিতে বদ্ধপরিকর হইতে হইবে। একমাত্র ইহার দ্বারাই বাঙ্গালীর প্রতিভা আত্মপ্রকাশ করিতে পারিবে, ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্রই শক্তিশালী হইবে।
ঢাকা প্রকাশ
১৫ ও ২২ ও এপ্রিল, ১৯৫১
পৃ. ১৩
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত