You dont have javascript enabled! Please enable it! 1952.02 | ঢাকার গােলযােগের কারণ কি? - সংগ্রামের নোটবুক

ঢাকার গােলযােগের কারণ কি?

“পূৰ্ব্ববঙ্গ আইন পরিষদ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সােপারিশ করা সত্ত্বেও শান্তি ও শৃখলাভঙ্গের জন্য ছাত্রবৃন্দ ও জনসাধারণকে সুপরিকল্পিতভাবে উস্কানী ও প্ররােচনা দেওয়া হচ্ছে। এ সকল ঘটনা এবং এর পদ্ধতি থেকে এটুকু সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যারা এ প্ররােচনা ও উস্কানী দিচ্ছে তাদের আদত উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে অরাজকতা ও অশান্তি সৃষ্টি করা”।“গত তিন চার দিন যাবত ঢাকা শহরে কয়েকটি অবাঞ্ছিত ও দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে, যার ফলে জনসাধারণের মধ্যে ভুল ধারনার সৃষ্টি হয়েছে। এ সম্পর্কে আপনাদের কাছে পরিষ্কারভাবে আমি কিছু বলা দরকার বলে মনে করছি।” গত ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাত্রে ঢাকা বেতার কেন্দ্র হইতে পূর্ববঙ্গের প্রধান মন্ত্রী জনাব নূরুল আমীন ঢাকার গােলযােগ সম্পর্কে বক্তৃতা করিতে যাইয়া এইসব কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরাে বলেন : আজ ঢাকা শহরে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
এ যাবত প্রেসনােটে কেবলমাত্র ঢাকা শহরে শান্তি ও শৃখলা নষ্ট করার যে সকল প্রচেষ্টা হয়েছে এবং এর ফলে যেসকল ক্ষতি হয়েছে ও সরকার যে সকল ব্যবস্থা নিয়েছেন কেবলমাত্র তাই উল্লেখ করা হয়েছে। ১৪৪ ধারা জারী করার কারণ ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হচ্ছে। এরূপও অভিযােগ করা হচ্ছে যে, ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার দাবীকে দমন করার জন্য। এসকল অভিযােগ সাধারণত কলকাতার খবরের কাগজগুলােতে করা হয় এ কাগজগুলাে সব সময়েই এ প্রদেশের জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করে। এবারে উপরােক্ত প্রচেষ্টা ঢাকার কোন কোন। মহল থেকেও করা হচ্ছে। শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য যে সকল কার্যকরী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কেও উত্তেজনামূলক মিথ্যা প্রচারণাপূর্ণ বিবৃতি দেয়া হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে যে, ঢাকার কোন কোন দৈনিক কাগজ-এ এ মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, গত শুক্রবার সামরিক বাহিনী নিরীহ লােকদের উপর গুলী ছেড়ে, বেয়নেট চার্জ করে এবং লুটপাট করে। এ খবর সম্পূর্ণ মিথ্যা।
যানবাহন চলাচল বন্ধ, দোকানদারদিগকে হরতাল পালন করার অনুরােধ বা হুমকি এবং সরকারী ও বেসরকারী অফিসসমূহের কর্মচারীদের কাজে যােগদানে বাধা দেয়ার প্রচেষ্টাকে সরকার এ যাবত মনে করেছেন যে, যে সকল ছাত্র বা ব্যক্তি হাঙ্গামার ফলে নিহত বা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি জনসাধারণের সমবেদনা প্রদর্শন। সেজন্য সরকার মিথ্যা অভিযােগ সম্পর্কে কোন প্রকার গুরুত্ব দেয়া সঙ্গত মনে করেন নি, উপরন্তু সরকার আশা করেছিলেন যে, গত বৃহস্পতিবার থেকে যে সকল ঘটনা ঘটেছে কেবলমাত্র তার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ দ্বারাই ১৪৪ ধারা জারী এবং শান্তি রক্ষার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থার কারণ ও যুক্তি জনসাধারণের নিকট সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।
কিন্তু তার পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এখন একথা বলা প্রয়ােজন হয়েছে যে, গত কয়েকদিনের হাঙ্গামা ও হাঙ্গামার ধারা এবং যারা এই হামার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে ও উস্কানী দিয়ে চলেছে তাদের প্রকৃত রুপ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আরও অধিক তথ্যাদি জানানাে আমার কর্তব্য।

১৪৪ ধারা কেন জারী করা হল?
বাংলা ভাষার আন্দোলন সম্পর্কে জনমতের কণ্ঠরােধ করার উদ্দেশ্যে ১৪৪ ধারা জারী করা হয়েছে বলে যে অভিযােগ করা হয়েছে তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ১৪৪ ধারা জারী করার সিদ্ধান্তের সঙ্গে ভাষার প্রশ্নের কোন সম্পর্ক নেই। প্রাদেশিক আইন সভার প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে শেষদিন পর্যন্ত শহরে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের উদ্দেশ্যে ছাত্রদের ভাষাআন্দোলনের সুযােগ নিয়ে কতিপয় সুবিধাবাদী ও বিভেদ সৃষ্টিকারী যে পরিকল্পনা নিয়েছিল, তার উপযুক্ত প্রমাণ পেয়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই জেলা কর্তৃপক্ষ ১৪৪ ধারা জারী করেছিলেন। জেলা কর্তৃপক্ষ যাতে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের যে কোনপ্রকার হুমকির মােকাবেলা করতে পারেন কেবলমাত্র সেজন্যই এই আদেশ জারীর দরকার হয়েছিল। ভাষার প্রশ্ন বা অন্য কোন বিষয় সম্পর্কে জনমতকে দমন করার কোন উদ্দেশ্য বা ইচ্ছা সরকারের ছিল না। এ কথাগুলাে যে সত্য তা প্রমাণিত হবে এই একটি বিষয় দ্বারা যে কেবলমাত্র পনের দিন আগে ঢাকা এবং প্রদেশের অন্যান্য জায়গায় বাংলা ভাষা সম্পর্কে মিছিল বার করা এবং সভা করায় সরকার কোন প্রকার বাধা দেন নি।
১৪৪ ধারা জারী করার পর থেকে যে পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে তা একথাই প্রমাণ করেছে যে, ভাষার প্রশ্ন না থাকলেও শান্তি এবং শৃখলা ভঙ্গের জন্য সুপরিকল্পিত চেষ্টা চলতাে। জনসাধারণ যে দুটি বিষয় জানেন, এখানে আমি তা উল্লেখ করলেই আমার আগেকার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণিত হবে। বিষয় দুটির প্রথমটি হলাে এই যে, ১৪৪ ধারা জারী দ্বারা মিছিল বা জনসভা বন্ধ করা হয়নি। ঐ আদেশে এ কথাই বলা হয়েছিল যে, জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের আদেশ নিয়ে মিছিল ও জনসভা করতে হবে। যারা মিছিল বা জনসভা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করা সম্পর্কে তাদের মতামত দিতে চেয়েছিলেন, তাদের জেলা মাজিষ্ট্রেটের অনুমতি পেতে কোন বাধা ছিল না, কিন্তু তারা কেউই অনুমতি চান নি। শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের উস্কানী দ্বিতীয়তঃ পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদ বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করা সত্ত্বেও শান্তি এবং শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য ছাত্রবৃন্দ ও জনসাধারণকে সুপরিকল্পিতভাবে উস্কানী ও প্ররােচনা দেওয়া হচ্ছে। এসকল ঘটনা এবং এর পদ্ধতি থেকে এটুকু সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, যারা এ প্ররােচনা ও উস্কানী দিচ্ছে তাদের আদত উদ্দেশ্য ব্যাপকভাবে অরাজকতা ও অশান্তির সৃষ্টি করা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে টানা হয়েছিল শুধু ছাত্রদের ও জনসাধারণের সহযােগিতা পাবার জন্য। এ সকল পদ্ধতি ও ধারার কয়েকটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে।
ঢাকার ঘটনাবলী সম্পর্কে মিথ্যা ও উত্তেজনামূলক গুজব শহরে ও শহরের বাইরে সারা প্রদেশে ব্যাপকভাবে ছড়ানাে হচ্ছে। যারা আইনভঙ্গ ও শান্তি নষ্ট করতে চায়, তারা মুসলিম লীগ এম, এল, এ এবং খবরের কাগজের অফিসের কর্মচারীদের হুমকি ও শাসানী দিচ্ছে, নিজেদের দুরভিসন্ধিতে সহায়তা করার জন্য। সাধারণ শাসন কার্য চালানাের কাজেও বাধা দেয়া হচ্ছে। ছাত্রদের মধ্যে বেশির ভাগই ভুলবশতঃ মনে করেছেন যে, এই দুষ্কৃতিকারীরা জাতির মহান কাজে নেমেছে। আইনভঙ্গ করার জন্য ছাত্রদিগকে ক্রমাগত চাপ দেয়া হচ্ছে। প্রদেশের অন্যান্য স্থানেও লােক পাঠানাে হচ্ছে আইন ভঙ্গ করার কাজে উস্কানী দেয়ার জন্য।

নাগরিকের সহযােগিতা প্রয়ােজন
আমি এখন আপনাদের কাছে যে ঘটনাবলী ও তথ্য খুলে বললাম, সেগুলাে এবং আরও অন্যান্য অনেক তথ্য সরকারের নিকট আছে। যাতে দৃঢ়ভাবে বলা যেতে পারে যে, আপতঃদৃষ্টিতে বাইরে থেকে যা দেখা যাচ্ছে প্রকৃত পরিকল্পনা তার চেয়ে অনেকাংশে ও বহুগুণে মারাত্মক। এই মারাত্মক পরিকল্পনার যারা প্রণেতা, তারা পাকিস্তানের বাইরে থেকে সহায়তা এবং অনুপ্রেরণা পাচ্ছে। এরূপ অবস্থায় পাকিস্তানের স্থায়িত্ব নষ্ট করার এই সকল মারাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ করতে এবং দুষ্ট পরিকল্পনা অকুরেই বিনষ্ট করতে সরকারকে সময় সময় যথাবিহিত কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, সরকার এই সকল দৃঢ় ব্যবস্থা অবলম্বনের কাজে পাকিস্তানের মঙ্গলাকাখী ও শান্তিকামী প্রতিটি নাগরিকের পূর্ণ সমর্থন ও সহায়তা লাভ করবেন।
EBGP-51/52 607। spl- 100 M

সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত