ঢাকার গােলযােগ সম্পর্কে মুসলিম লীগ
নেতৃবৃন্দের বিবৃতি
ঢাকার সাম্প্রতিক গােলযােগ সম্পর্কে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতৃবর্গ গত ২৭শে ফেব্রুয়ারী তারিখে নিম্নোক্ত বিবৃতি প্রচার করিয়াছেন :
গত সপ্তাহে ঢাকা শহরে গুলীচালনার ফলে যে বেদনাদায়ক ঘটনা সংঘটিত হইয়াছে, তৎসম্পর্কে প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটী গভীর দুঃখ প্রকাশ করিয়া নিহত ব্যক্তিদের শােক সন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিয়াছেন। হাইকোর্টের বিচারপতি লইয়া একটি নিরপেক্ষ উচ্চক্ষমতা বিশিষ্ট তদন্ত কমিটী গঠন করতঃ প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি বিধান এবং নিহত ব্যক্তিদের পরিবারবর্গকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ওয়ার্কিং কমিটী সরকারের নিকট দাবী জানাইয়াছেন। ঢাকা শহরে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়া আসার সঙ্গে সঙ্গেই ১৪৪ ধারা এবং সান্ধ্য আইন তুলিয়া লইবার জন্যও সরকারকে অনুরােধ করা হইয়াছে। প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটী, প্রাদেশিক মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টী এবং প্রাদেশিক আইনসভা বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার যে প্রস্তাব সৰ্ব্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করিয়াছেন, তাহা যাহাতে গণপরিষদে গৃহীত হয় তজ্জন্য ওয়ার্কিং কমিটী সর্বপ্রকার চেষ্টা করিতে বদ্ধ পরিকর।
দুঃখের বিষয়, আমাদের সরলপ্রাণ ছাত্রবৃন্দের এই আন্দোলনকে অবলম্বন করিয়া রাষ্ট্রের দুষমন ও স্বার্থন্বেষী ব্যক্তিগণ জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি এবং আইন ও শৃখলা ভঙ্গ করিয়া দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করিবার প্রয়াস পাইতেছে। এই আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বহু সন্ত্রাসবাদী ও কম্যুনিষ্টকর্মী এবং পাকিস্তানের শত্রুর গুপ্তচর অলক্ষে পাকিস্তানে প্রবেশ করিয়া ভিত্তিহীন, উত্তেজনামূলক, অতিরঞ্জিত প্রচারণা ও গুজব রটাইয়া এবং অজস্র অর্থ ব্যয়ে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করিতেছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ক্ষমতালােলুপ কতিপয় ব্যক্তি ইহাকে সুবর্ণ সুযােগ মনে করিয়া ইন্ধন যােগাইতেছে। পুলিশ তদন্তে বহু বেআইনী, ধ্বংসাত্মক ও প্রচারণামূলক কাগজপত্র, কম্যুনিষ্ট নীতিপূর্ণ পুথিপুস্তক এবং কিছু অস্ত্রশস্ত্রও ধরা পড়িয়াছে। তাছাড়া কয়েকজন কম্যুনিষ্ট সন্ত্রাসবাদী ও শত্রুপক্ষের চরকেও ইতিমধ্যে গ্রেফতার করা হইয়াছে। দুর্ঘটনার তদন্তকাৰ্য্য সমাপ্ত হওয়ার এবং লীগ ওয়ার্কিং কমিটী ও সরকার কর্তৃক অগীকৃত বিচার হওয়ার অপেক্ষা না করিয়া দেশে এইভাবে বেপরােয়া উত্তেজনামূলক আন্দোলন চালাইতে থাকিলে দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি ভঙ্গ হইয়া পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিপন্ন হওয়ার আশভকা রহিয়াছে। আজ এইরূপ সঙ্কটপূর্ণ সময়ে যখন পাকিস্তানের সীমান্তে হাজার হাজার শত্ৰসৈন্য পাকিস্তানের প্রতি কামান উচাইয়া সুযােগের অপেক্ষায় ওৎ পাতিয়া রহিয়াছে, তখন দেশের ভিতরে এমন শােচনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়া যে কতটুকু মারাত্মক তাহা প্রত্যেক পাকিস্তান দরদীকে আন্তরিকভাবে অনুভব করিতে হইবে। যে মুসলিম লীগের আপ্রাণ চেষ্টায় এবং ত্যাগের ফলে পাকিস্তান অর্জিত হইয়াছে তাহার মূলােৎপাটন করতঃ কম্যুনিজমের বীজ রােপণ করিয়া পাকিস্তানের ধ্বংস সাধনই আমাদের দুষমনদের মুখ্য উদ্দেশ্য।
দেশের এহেন চরম সঙ্কটের সময়ে আমরা দেশপ্রাণ ভাইদের কাছে, বিশেষ করিয়া মুসলিম লীগ কর্মী, জেলা, মহকুমা ও শাখা লীগ কর্তৃপক্ষ এবং ছাত্র বন্ধুগণকে এই সমস্ত অবস্থা বিশেষভাবে উপলব্ধি করিতে এবং শান্তি ও শৃখলা বজায় রাখার কাৰ্য্যে সর্বপ্রকার সাহায্য করিতে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাইতেছি।
লক্ষ্য করা যাইতেছে যে এই আন্দোলনকে উপলক্ষ করিয়া কতগুলি আপত্তিকর প্রচারপত্র বিলি করা হইতেছে এবং অনেক অসংগত বিবৃতি প্রচার করা হইতেছে। এই সকল প্রচারপত্র, বিবৃতি এবং নানাপ্রকার গুজব দ্বারা আইন ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের উস্কানী দেওয়া হইতেছে বলিয়া স্পষ্ট বুঝা যাইতেছে। পাকিস্তানের প্রত্যেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশেষভাবে চিন্তা ও প্রতিকারের চেষ্টা করার জন্য আমরা সনির্বন্ধ অনুরােধ জানাইতেছি।
– স্বাক্ষর –
মােহাম্মদ আবদুল্লাহেল বাকী,
প্রেসিডেন্ট, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ
খাজা হাবিবুল্লাহ,
ভাইস প্রেসিডেন্ট,
পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটীর সদস্য
গিয়াসুদ্দীন পাঠান,
জয়েন্ট সেক্রেটারী পাকিস্তান মুসলিম লীগ
ও পূৰ্ব্ব পাক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটীর সদস্য।
ইউসুফ আলী চৌধুরী,
সেক্রেটারী, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক
মুসলিম লীগ।
শাহ আজিজুর রহমান,
জয়েন্ট সেক্রেটারী, পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগ
মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটীর প্রস্তাব
গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী তারিখে অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটীর সভায় ঢাকার অবাঞ্ছিত গােলযােগ সম্পর্কে নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয় :
‘পুলিশের গুলী চালনার ফলে কতিপয় ছাত্র ও জনসাধারণের মর্মান্তিক মৃত্যুতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটীর এই সভা গভীর শােক প্রকাশ করিতেছে। এই সভা তাহাদের শােক সন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি এবং আহত ব্যক্তিদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে।
এই সভা পূর্ববঙ্গ সরকারের নিকট দাবী করিতেছে যে, এ সম্পর্কে অবিলম্বে হাইকোর্টের বিচারপতিগণের দ্বারা তদন্তের আদেশ দেওয়া হউক এবং যাহারা দোষী সাব্যস্ত হয় তাহাদিগকে কঠোর শাস্তি দেওয়া হউক।
এই সভা সরকারের নিকট আরও দাবী করিতেছে যে মৃত ব্যক্তদের পরিবারবর্গকে যথােপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দানের ব্যবস্থা করা হউক।
এই সভা ছাত্র ও জনসাধারণের নিকট ধৈৰ্য্যধারণ করিয়া দেশে শান্তি ও শৃংখলা বজায় রাখার চেষ্টা করিবার এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরাইয়া আনিবার আবেদন জানাইতেছে। এই সভা মুসলিম লীগের ইউনিটসমূহের প্রতি ও লীগ কর্মীগণের প্রতি কর্ত্তব্য পালনে অগ্রসর হইবার এবং আইন ও শৃঙখলা পুনরায় আনয়নের জন্য কাজ করিবার আহ্বান জানাইতেছে।”
২৫ শে ফেব্রুয়ারী তারিখে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটীর সভায় আরাে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া বলা হয় :
ওয়ার্কিং কমিটী অতীব দুঃখের সহিত লক্ষ্য করিয়াছেন যে, কম্যুনিষ্ট ও বিদেশী চরেরা যথেষ্ট প্রস্তুতি সহকারে পূর্ববঙ্গে প্রবেশ করিতেছে এবং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও হতাশ রাজনৈতিক সুবিধাবাদীদের সহযােগিতায় এই আন্দোলনকে তাহাদের ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য সাধনে নিয়ােজিত করিবার চেষ্টা করিতেছে। তাহারা রেলগাড়ী থামাইয়া, রেল লাইন তুলিয়া ফেলিয়া, টেলিগ্রাফ, টেলিফোন ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নষ্ট করিয়া এবং জনসাধারণকে হত্যা ও মারপিটের ভয় দেখাইয়া সরকারকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র করিতেছে। দেশে অরাজকতা ও উশৃখলতার সৃষ্টি করিয়া পাকিস্তান ধ্বংস করার জন্য তাহারা ব্যাপক ধ্বংসাত্মক অভিযান শুরু করিয়াছে।
বিরাট আত্মত্যাগ, বহু রক্তক্ষয় ও কষ্টের বিনিময়ে পাকিস্তান অর্জিত হইয়াছে এই কথা উপলব্ধি করিবার জন্য ওয়ার্কিং কমিটী এতদ্বারা দেশপ্রাণ ছাত্র ও জনসাধারণের নিকট আবেদন করিতেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর হইতেই পাকিস্তানকে গড়িয়া তােলার জন্য আমাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা শত্রুরা ব্যর্থ করার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু পাকিস্তানের জনসাধারণ বরাবরই সাফল্যের সহিত তাহাদের ধ্বংসাত্মক ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করিয়াছে। যে ছাত্র ও সুনসাধারণের আত্মত্যাগের ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, ওয়ার্কিং কমিটী তাহাদের নিকট আবেদন করিতেছেন যেন এই মহান রাষ্ট্রের নাগরিক হিসাবে তঁাহারা নিজ দায়িত্ব উপলব্ধি করিয়া স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ফিরাইয়া আনার জন্য এবং পাকিস্তানের মর্যাদা ও স্থায়িত্ব বজায় রাখার জন্য একতাবদ্ধ থাকেন। ওয়ার্কিং কমিটী উপলব্ধি করিতেছেন যে, আমাদের নিজেদের মধ্যে একতা ও দৃঢ়তা বজায় রাখার আবশ্যকতা আজ যেরূপভাবে দেখা দিয়াছে, পাকিস্তানের ইতিহাসে ইতিপূর্বে আর কখনও সেরূপ দেখা দেয় নাই।
ওয়ার্কিং কমিটী জনসাধারণকে দৃঢ় আশ্বাস দিতেছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য লীগ পার্লামেন্টারী পাটী এবং প্রাদেশিক আইনসভা যে সুপারিশ করিয়াছেন, পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক সেই সুপারিশ গ্রহণ করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি সর্বপ্রকার চেষ্টা করিবেন। ‘
ওয়ার্কিং কমিটী ছাত্র ও জনসাধারণের নিকট, বিশেষ করিয়া এই আন্দোলনের প্রকৃত উদ্যোক্তাগণের নিকট আরও আবেদন করিতেছেন, তাহারা যেন ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে লিপ্ত ব্যক্তিদের সহিত যাবতীয় সম্পর্কচ্ছেদ করেন এবং আমাদের কষ্ট-লক্ক আজাদীর ধ্বংস করার জন্য শত্রুদের ষড়যন্ত্রের হাত হইতে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে সাহায্য করেন।
“পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হইয়া প্রদেশের সর্বত্র আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখার কাজে সহায়তা করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটী বিশেষ করিয়া লীগ কর্মীবৃন্দের নিকট আবেদন করিতেছেন।”
লীগ পালমেন্টারী পার্টির প্রস্তাব
গত ২৩শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ব্যবস্থা পরিষদের মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায়ও নিম্নোক্ত প্রস্তাব গৃহীত হয় :
১। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির এই সভা পার্টির নেতা জনাব নুরুল আমীনের উপর আস্থা জ্ঞাপন করিতেছে।
২। পার্লামেন্টারী পার্টির সভা গত ২১শে ও ২২শে ফেব্রুয়ারী তারিখে ঢাকার বুকে গুলীবর্ষণের ফলে ছাত্রদেরসহ যে পাচ ব্যক্তি নিহত হইয়াছেন তাহার জন্য গভীর দুঃখ প্রকাশ করিতেছে এবং শােকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করিতেছে। যাহারা আহত হইয়াছেন তাহাদের জন্যও এইসভা গভীর সহানুভূতি জানাইতেছে।
৩। পার্লামেন্টারী পার্টির সভা দাবী করিতেছে যে, একজন হাইকোর্টের জজের সভাপতিত্বে একটি স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটী গঠন করিবার যে কথা প্রধানমন্ত্রী পরিষদ ভবনে ঘােষণা করিয়াছিলেন, তাহা যেন অনতিবিলম্বে গঠন করা হয় এবং গুলীবর্ষণ ব্যাপারে তাহাদের যেন পুখানুপুঙ্খ তদন্ত করেন। সভা আরও দাবী করে যে, দোষী ব্যক্তিদের যেন আদর্শ শাস্তি দেওয়া হয়।
৪। পাটী সরকারের কাছে এই দাবী পেশ করিতেছে যে, শহরের বর্তমানের উত্তেজক পরিস্থিতি শান্ত হইয়া আসিবার সাথে সাথেই যেন ১৪৪ ধারা তুলিয়া নেওয়া হয়।
সূত্র: ভাষা আন্দোলনের দলিলপত্র – রতন লাল চক্রবর্ত্তী সম্পাদিত